সিঙ্গাপুরের মাদরাসা শিক্ষা ব্যবস্থায় শিক্ষক প্রশিক্ষণ : পর্যবেক্ষণ ও পরামর্শ

সিঙ্গাপুরের মাদরাসা শিক্ষা ব্যবস্থায় শিক্ষক প্রশিক্ষণ : পর্যবেক্ষণ ও পরামর্শ

বিশ্বজুড়ে খ্যাত ও স্বীকৃত প্রবাদ ” শিক্ষা জাতির মেরুদন্ড।” এ প্রবাদটি শিক্ষার গুরুত্ব কতটা তার প্রতি যথাযথ নির্দেশ করে। মেরুদন্ড দূর্বল হলে প্রাণী যেমন দুর্বল হয় তেমনি শিক্ষা ব্যবস্থা দুর্বল হলে গোটা জাতি অন্তসারশুন্য এক জাতিতে পরিণত হতে বাধ্য।

শিক্ষাকে সবল ও শক্তিশালী করার জন্য অনেক কিছু প্রয়োজন। যেমন, যুগোপযুগী কারিকুলাম, মানসম্মত ভৌত অবকাঠামো, দুর্নীতিমুক্ত প্রশাসন, যোগ্য শিক্ষক ও বাস্তবসম্মত পদক্ষেপ। এসব কিছুর মধ্যে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ হচ্ছে যোগ্য ও দক্ষ শিক্ষক গড়ে তোলা। অন্যান্য দিকগুলির দুর্বলতা থাকলে তা অনেকসময় সামান্য পদক্ষেপের দ্বারা কিছুটা কাটিয়ে ওঠা সম্ভব হয়। কিন্তু শিক্ষক যদি অদক্ষ ও অযোগ্য হয় তবে তার নেগিটিভ প্রভাব এতটা বেশী যা থেকে উত্তোরণ পাওয়া সম্ভব হয় না। এ জন্য শিক্ষার কল্যাণ ও উন্নয়ন করতে সর্বাগ্রে শিক্ষক তৈরীর কাজকে অগ্রাধিকার দিতে হবে। 

বাংলাদেশে শিক্ষার মানোন্নয়নে সরকারী ও বেসরকারী পর্যয়ে প্রতিনিয়ত বেশ কিছু উদ্যোগ গৃহীত হয়ে আসছে । এসব উদ্যোগের মধ্যে ৫টি এইচএসটিটিআই, ১১টি টিটিসি (ডাবল শিফসসহ) ৫৪টি পিটিআই এর মাধ্যমে নিয়মিত শিক্ষক প্রশিক্ষণ এবং এর পাশাপাশি টিকিউআই, এসইএসডিপি, এ টু আই ইত্যাদি প্রকল্পের মাধ্যমে শিক্ষক প্রশিক্ষণ কার্যক্রম চলমান রয়েছে। কিন্তু দুঃখ জনক বাস্তবতা হল এ সকল প্রশিক্ষণ শুধুমাত্র সাধারণ শিক্ষা ধারার শিক্ষকদের জন্য অথবা মাদরাসা শিক্ষা ধারায় চাকুরীরত সাধারণ বিষয়ের শিক্ষকদের জন্য নির্ধারিত। এসব প্রশিক্ষণের আওতায় এ যাবৎ কোন মাদরাসা শিক্ষায় শিক্ষিত ( ফাজিল/ কামিল পাশ) শিক্ষকদের অন্তুর্ভূক্ত করা হয়নি। অথচ বাংলাদেশ সরকার স্বীকৃত মাদারাসা সংখ্যা প্রায় ১০,০০০ (দশ হাজার) । যাতে এবতেদায়ী , দাখিল, আলিম, ফাজিল ও কামিল স্তরসহ প্রায় ৭০ হাজার শিক্ষক কর্মরত আছেন। এসব শিক্ষকদের প্রশিক্ষণের আওতায় না আনা হলে তাদেরকে যোগ্য ও দক্ষ করে গড়ে তোলা সম্ভব নয় আর তাদেকে তৈরী করতে না পারলে উন্নত ও কাংখিত জাতি উপহার দেয়ার স্বপ্ন অবাস্তব। 

সিঙ্গাপূর পূর্ব এশিয়ার ছোট্ট একটি দেশ । মাত্র ৪৫ লক্ষ মানুষের এ দেশে ৫% জনগণ মুসলিম। এই স্বল্প সংখ্যক মুসলিম জনগোষ্ঠির জন্য সরকারী অনুমোদনে এবং বেসরকারী ব্যবস্থাপনায় এমন একটি ইসলামী শিক্ষা তথা মাদরাসা শিক্ষা ব্যবস্থা গড়ে উঠেছে যা বিস্ময়কর। না দেখলে তা বিশ্বাস করা যাবে না। মুইস (MUIS) নামক একটি বেসরকারী সংগঠনের প্রত্যক্ষ তত্ববধায়নে সিঙ্গাপুরে ৬টি মাদরাসা পরিচালিত। এর বাইরে আলাদা কোন মাদরাসা নেই। তাদের ইসলামী শিক্ষা বা মাদরাসা শিক্ষা থেকে অভিজ্ঞতা অর্জনের নিমিত্তে বাংলাদেশস্থ আমেরিকান এ্যাম্বাসীর কালচারাল সেন্টারের ব্যবস্থানায় এবং মুইস (MUIS) এর সহযোগিতায় বাংলাদেশের একটি টিম গত ২-৬ অক্টোবর, ২০১০ সিঙ্গাপুর সফর করে। ঐ টিমের একজন সদস্য হিসেবে আমারও সিঙ্গাপুরের ইসলামী শিক্ষা ব্যবস্থা সম্পর্কে জানার সুযোগ হয়। 

আমি সে দেশের মাসরাসা শিক্ষার মান ও কোয়ালিটি দেখে বিস্মিত হয়েছি। সেখানে মাদরাসা শিক্ষার্থীরা এমনভাবে তৈরী হবার সুযোগ পাচ্ছে যে, তারা একদিকে ঐদেশের ন্যাশনাল কারিকুলামের আওতায় সেন্ট্রাল পরীক্ষায় অংশগ্রহণ করে কৃতিত্বের স্বাক্ষর রাখছে, সেদেশের সরকারী স্বীকৃতি পেয়ে বিভিন্ন ধরনের কর্মস্থলে চাকুরী করার সুযোগ পাচ্ছে অন্যদিকে তাদের মধ্যে যারা আগ্রহী তারা ইংলিশ মিডয়ামের ও লেভেল এবং এ লেভেল পরীক্ষায় অংশ গ্রহণ করে ইন্টারন্যাশনাল স্বীকৃতি পাচ্ছে আবার ইসলামী শিক্ষা অর্জন করার ফলে আর্ন্তাতিক ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয় মালয়েশিয়া, আল আযহার বিশ্ববিদ্যালয় মিশর এবং আরব বিশ্বের বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়াশুনার সুযোগ পেয়ে ইসলামিক স্কলার হবার সুযোগ পাচ্ছে। ঐসব মাদরাসার শিক্ষার্থীরা মালয় ভাষা সহ ইংরেজি ও আরবি ভাষায় বেশ দক্ষতার পরিচয় দিয়ে থাকে। ইংরেজিতে দক্ষ হবার বিষয়টি আমাদের কাছে তেমন বিস্ময়ের মনে হয়নি। বিস্ময় হল তাদের আরবি বলার মান দেখে। শিক্ষার্থীদের অনেকে এমনকি মেয়েরাও বেশ সহজেই আরবি ভাষায় যোগাযোগ করতে সক্ষম বলে আমাদের কাছে মনে হয়েছে। 

আমি মনে করি এসবই সম্ভব হয়েছে সেসব মাদরাসার শিক্ষকদের নিষ্ঠা, আন্তরিকতা এবং তাদের দক্ষতার বলে । আর দক্ষ শিক্ষক তৈরীর জন্য মুইসের (MUIS) রয়েছে বেশ কিছু পদক্ষেপ। শিক্ষকদের পেশাগত দিক থেকে দক্ষ করে গড়ে তুলতে যেসব ব্যবস্থা প্রচলিত আছে তার কতগুলি দিক হল-
১. অনার্স পর্যায়ে এডুকেশন এর উপর ডিগ্রী গ্রহণ করা।
২. শিক্ষকদের জন্য একবছর মেয়াদী শিক্ষক প্রশিক্ষণ যা বাংলাদেশের বিএড পর্যায়ের।
৩. মাদরাসা শিক্ষকদের জন্য মুইস (MUIS)  কর্তৃপক্ষের ব্যবস্থাপনায় পার্টটাইম শিক্ষক প্রশক্ষণ। এর মেয়াদ ২ বছর।
৪. শিক্ষকদের আসিটিতে দক্ষ করে গড়ে তুলতে বিশেষ প্রশিক্ষণ।
৫. স্বল্পমেয়াদী প্রশিক্ষণ।
৬. প্রশিক্ষণের উপর ভিত্তি করে শিক্ষকের বেতন বৃদ্ধি ও প্রমোশন দেয়ার ব্যবস্থা।

এ হল সিঙ্গাপুরের শিক্ষক প্রশিক্ষণের বাস্তব চিত্র। বাংলাদেশে এ ধরণের প্রশিক্ষণ যে নেই তা কিন্তু নয়। ইতোপূর্বে আমি উল্লেখ করেছি যে, বাংলাদেশের সাধারণ শিক্ষা ধারার শিক্ষকদের জন্য বিভিন্ন মেয়াদী প্রশিক্ষণ কার্যক্রম অব্যাহত আছে। সমস্যা শুধু মাদরাসার ঐসব শিক্ষকদের বেলায় যারা মাদরাসা থেকে ফাজিল কিংবা কামিল পাশ করে শিক্ষকতার পেশায় আত্মনিয়োগ করছেন। তাদের জন্য আলীয়া মাদরাসা প্রতিষ্ঠার ২০০ বছর পর আর বাংলাদেশ স্বাধীনতা লাভের ৩২ বছর পর প্রকৃত অর্থে ২০০২ সাল থেকে বিএমটিটিআই এর মাধ্যমে স্বল্প মেয়াদী চাকুরীকালীন প্রশিক্ষণ কার্যক্রম আরম্ভ হয়েছে। তাদের প্রত্যেককে যদি স্বল্পমেয়াদী এই পশিক্ষণের আওতাভুক্ত করতে হয় তাহলে বিএমটিটিআই এর ন্যূনতম ৫০ বছর সময়ের প্রয়োজন হবে। আর এই দীর্ঘ সময়ের ব্যবধানে অসংখ্য শিক্ষক প্রশিক্ষণ গ্রহণ না করেই ইন্তেকাল করবেন আর অনেকে নতুন নিয়োগ লাভ করবেন। এসব বিবেচনায় বাংলাদেশের মাদরাসা শিক্ষকদের জন্য প্রশিক্ষণ কার্যক্রম তরান্বিত করতে আমি নিম্ন কতিপয় শুপারিশ তুলে ধরছি।
১. বোংলাদেশে বর্তমানে যেসব শিক্ষার্থী সরকারের স্বীকৃতি অনুযায়ী ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয়ের অধীনে ফাজিল ও কামিল ডিগ্রী অর্জন করছে তাদেরকে সকল টিটিসির আওতায় বিএড/ এমএড ডিগ্রী অর্জনের নিমিত্তে ভর্তির সুযোগ নিশ্চিত করা।
২. টিটিসিগুলিতে মাদরাসা শিক্ষার্থীদের জন্য কোটা নির্ধারণ করার ব্যবস্থা করা।
৩. বিএমটিটিআই এর মাধ্যমে শুধুমাত্র মাদরাসা শিক্ষকদের জন্য বিএড/ এমএড কোর্স প্রবর্তন করা আর তার সনদ জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়/ ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয় থেকে প্রদানের ব্যবস্থা করা।
৪. যেসব শিক্ষক এক বছর মেয়াদী প্রশিক্ষণ কোর্স সমাপ্ত করবেন তাদের জন্য শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের নীতিগত এ সিদ্ধান্ত গ্রহণ করা যে, এসব মদরাসা শিক্ষকদের যারা বিএড/ এমএড ডিগ্রী অর্জন করবেন তাদেরকে স্কুল শিক্ষকদের ন্যায় উচ্চতর বেতন স্কেল প্রদান করা হবে।
৫. বর্তমানে কর্মরত যেসব মাদরাসা শিক্ষকদের বিএড/ এমএড কোর্স করার সুযোগ নেই তাদের প্রত্যেককে একটি প্রকল্পের আওতায় মধ্যম মেয়াদের (তিন মাস/ চার মাস) প্রশিক্ষণের আওতায় আনার ব্যবস্থা করা। এবং তাদের জন্য একটি বিশেষ ইনক্রিমেন্ট এর ব্যবস্থা করা। 
৬. এবতেদায়ী মাদরাসা শিক্ষকদের জন্য পিটিআইগুলোতে কোটা নির্দ্দিষ্ট করে দেয়ার মাধ্যমে তাদের জন্য প্রশিক্ষণ নিশ্চিত করা।
৭. সাধারন শিক্ষার ন্যায় মাদরাসা শিক্ষায় শিক্ষিতদের জন্য বিএমটিটিআই এর অনুরূপ দেশের ৬টি বিভাগে আরো ৬টি ইনস্টিটিউট স্থাপন করা।
৮. শিক্ষকদের যে সকল সংগঠন রয়েছে যেমন বাংলাদেশ জমিয়াতুল মুদাররেসীন/ বাংলাদেশ মাদরাসা শিক্ষক পরিষদ ইত্যাদির পক্ষ থেকে এলাকা বেইজড/ প্রতিষ্ঠান বেইজড শিক্ষক প্রশিক্ষণের আয়োজন করা।
৯. পার্ট টাইম অর্থাৎ শিক্ষকদের বিকাল বেলায় ক্লাশের ব্যবস্থা করে প্রশিক্ষণ প্রোগ্রামের আয়োজন করা। দীর্ঘ মেয়াদী প্রশিক্ষণদানের পর সনদ প্রদানের ব্যবস্থা করা। এতে কর্মরত শিক্ষকদের ক্লাসের ব্যঘাত হবে না।
১০. প্রশিক্ষিত শিক্ষকদের জন্য মাঝে মধ্যে স্বল্পমেয়াদী সঞ্জীবনী কোর্স এর ব্যবস্থা করা। 
প্রশিক্ষণের মাধ্যমেই শিক্ষকদের মানোন্নয়ন সম্ভব। আর গুণগত মান সম্পন্ন শিক্ষকদের মাধ্যমেই শিক্ষাকে তার লক্ষ্য পানে নিয়ে যাওয়া সম্ভব। সিঙ্গাপুরের মত সংখ্যালঘু মুসলমানের দেশে যদি ইসলামী শিক্ষা ও আরবি ভাষা উন্নয়নের জন্য চমৎকার চমৎকার উদ্যোগ নেয়া সম্ভব হয় তবে আমরা কেন পারব না। নিশ্চয় পারব। এ জন্যে আমাদের সর্বাতœক চেষ্টা ও সদিচ্ছা থাকতে হবে। আল্লাহ আমাদের সংশ্লিষ্ট প্রত্যেককে যথাযথ উদ্যোগ গ্রহণ করে তা বাস্তবায়নের তৌফিক দান করুন। আমিন!
মোঃ নূরুল্লাহ
প্রভাষক, বিএমটিটিআই, গাজীপুর

nibrasbd