অতীত ও বর্তমান প্রেক্ষাপটে নারী ও শিশু পাচার এবং তা রোধে ইসলামী আইন ও মূল্যবোধের কার্যকর ভূমিকা

অতীত ও বর্তমান প্রেক্ষাপটে নারী ও শিশু পাচার এবং তা রোধে ইসলামী আইন ও মূল্যবোধের কার্যকর ভূমিকা

ইসলাম মানবতার ধর্ম। মানুষের কল্যাণ সাধনই ইসলামের লক্ষ্য। এজন্য আল কুরআন ও সুন্নাহর সকল আলোচনা মানবকেন্দ্রিক। ইসলামী বিধি-বিধান সর্বকালের ও সর্বযুগের জন্য উপযোগী।

এ কথার সত্যতা ঘোষণা করে মহান আল্লাহ ইরশাদ করেন, “নিশ্চয়ই আল্লাহর নিকট গ্রহণযোগ্য একমাত্র দীন তথা জীবন বিধান হচ্ছে ইসলাম।” তিনি অন্যত্র বলেন, “আজ আমি তোমাদের জন্য তোমাদের দীনকে পরিপূর্ণ করে দিলাম, আর তোমাদের উপর আমার নিয়ামত পরিপূর্ণ করলাম এবং ইসলামকে তোমাদের জন্য দীন হিসেবে মনোনীত করলাম।” 
ইসলাম নারী ও শিশুকে যথাযথ মর্যাদা ও সম্মান প্রদান করেছে। কন্যা, জায়া ও জননী এর যে কোনটিই নারীর পরিচয় হোক না কেন, ইসলাম তাদের সকল অধিকার সংরক্ষণ করে।
ইসলামে মা হিসেবে নারীর মর্যাদা সর্বাধিক। মহান আল্লাহ মায়ের সম্মান বর্ণনা করে বলেন, “আর আমি মানুষকে তার পিতা-মাতার প্রতি সদাচরণের নির্দেশ দিয়েছি। তার মা তাকে সীমাহীন কষ্ট করে গর্ভে ধারণ করেছে এবং তার দুধ ছাড়াতে সময় লেগেছে দুই বছর। অতএব আমার প্রতি ও তোমার মাতা-পিতার প্রতি কৃতজ্ঞতা প্রকাশ কর।”

মায়ের মর্যাদা সম্পর্কে হাদীস শরীফে এভাবে একটি বর্ণনা রয়েছে, “জনৈক সাহাবী নবী করীম সাল্লাল্লাহু আলায়হি ওয়াসাল্লামের কাছে এসে জিজ্ঞাসা করলেন, কে আমার কাছ থেকে উত্তম ব্যবহার পাওয়ার সবচেয়ে বেশি অধিকারী? তিনি বললেন, তোমার মা। সাহাবী বরলেন, তারপর কে? তিনি বললেন, তোমার মা। সাহাবী আবার জিজ্ঞেস করলেন, তারপর কে? এবারও তিনি বললেন, তোমার মা। সাহাবী আবার জিজ্ঞেস করলেন, তারপর কে? এবার তিনি বললেন, তোমার পিতা।” 
স্ত্রী হিসেবে নারীর মর্যাদা ইসলামে সুপ্রতিষ্ঠিত। এ সম্পর্কে আল্লাহ বলেন, “তোমরা তোমাদের স্ত্রীদের সাথে ন্যায়সংগতভাবে জীবন যাপন কর।” তিনি আরো বলেন, “তারা (স্ত্রীগণ) তোমাদের পরিচ্ছদ স্বরূপ এবং তোমরা তাদের (স্ত্রীদের) পরিচ্ছদ স্বরূপ।” তিনি আরো বলেন, ‘আর আল্লাহর অন্যতম একটি নিদর্শন এই যে, তিনি তোমাদের মধ্য হতে তেমাদের স্ত্রীগণকে সৃষ্টি করেছেন যাতে তোমরা তাদের সাথে সুখে বসবাস যে, তিনি তোমাদেরই মধ্য হতে তোমাদের স্ত্রীগণকে সৃষ্টি করেছেন যাতে তোমরা তাদের সাথে সুখে বসবাস করতে পার। আর তিনি তোমাদের পরস্পরের মধ্যে অনুরাগ ও দয়া সৃষ্টি করেছেন। নিশ্চয়ই এতে চিন্তাশীল ব্যক্তিবর্গের অন্য নিদর্শন রয়েছে।” 
ইসলাম নারীর মর্যাদা প্রতিষ্ঠার জন্য সতী স্বাধী স্ত্রীদের প্রতি অসত্য অপবাদ আরোপের বিরুদ্ধে কঠিন শাস্তির বিধান করেছে। আল্লাহ তাআলা বলেন, “যারা সতী সাধ্বী নারীর প্রতি অপবাদ আরোপ করে অথচ তার সপক্ষে চারজন সাক্ষী উপস্থাপন করতে সক্ষম হয় না তাদেরকে (অপবাদকারীকে অপবাদের শাস্তি হিসেবে) আশি ঘা বেত্রাঘাত করো এবং আর কগখনোই তাদের সাক্ষ্য গ্রহণ করো না। এসব ব্যক্তিরা পাপাচারী, ফাসেক।” বিদায় হজ্জের ভাষণে নবী করীম সাল্লাল্লাহু আলায়হি ওয়াসাল্লাম বলেছেনঃ “তোমরা তোমাদের স্ত্র দের ব্যাপারে হিতাকাক্সক্ষী হও, তাদের কল্যাণ কামনা কর।” 
ইসলাম কন্যা হিসেবেও নারীর যথার্থ মর্যাদা প্রদান করেছে। রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন, “যে ব্যক্তি তিনটি কন্যা কন্তান লালন পালন করে, তাদের শিক্ষার ব্যবস্থা করে, বিবাহ দেয় ও তাদের সাথে সদাচরণ করে তার জন্য রয়েছে জান্নাত।” তিনি আরো বলেন, “তোমাদের যদি কোন সন্তান থাকে তবে তার প্রতি সদয় থাকো। এ সব কন্যা তার জন্য জাহান্নাম থেকে বাঁচার রক্ষা কবচ হবে।” 
ইসলাম শিশুদের প্রতি অত্যন্ত যতœশীল। ইসলামের নবী শিশুদের ভালবাসতেন। তিনি অনেক সময় শিশুদের খেলার সাথী হতেন। একদা তিনি মিম্বরে দাঁড়িয়ে খুতবা দিচ্ছিলেন। এমন সময় সেখানে হাসান ও হুসাইন রাযিয়াল্লাহু আনহুমা এসে উপস্থিত হন। নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম মিম্বর থেকে নেমে এসে তাঁদেরকে কোলে তুলে নেন। এরপর সামনের সারিতে তাদেরকে বসিয়ে যথারীতি খুতবা প্রদান করেন। শিশুদের প্রতি সদয় হওয়ার উপর গুরুত্বরোপ করে রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেন, “যে ব্যক্তি ছোটদের øেহ করে না আর বড়দের সম্মান করে না সে আমার উম্মতের অন্তর্গত নয়।” 
ইসলাম নারী ও শিশুর যে মর্যাদা দিয়েছে তা যথাযথভাবে সমাজে বাস্তবায়িত না থাকার ফলে আমাদের সমাজে নারী ও শিশুরা আজ অবহেলিত, নির্যাতিত। 
যে সব উপায়ে নারী ও শিশুদের উপর নির্যাতন করা হয় পাচার তার মধ্যে একটি। ইসলাম যে কোন নির্যাতনের প্রতিরোধে সোচ্চার । তাই নারী ও শিশু পাচার রোধে ইসলামের ভূমিকা অত্যন্ত বলিষ্ঠ। বর্তমান প্রবন্ধে এর কতিপয় গুরুত্বপূর্ণ দিক তুলে ধরে তা প্রতিরোধে ইসলামী আইন ও মূল্যবোধে কার্যকর পদক্ষেপসমূহ আলোচনা করা হলো। 
১.০. পাচারের সংজ্ঞা, প্রকৃতি, উদ্দেশ্য ও কৌশল 
১.১. পাচার কি
‘পাচার’ শব্দের ইংরেজি প্রতিশব্দ হচ্ছে, ঞৎধভভরপশরহম, করফহধঢ়ঢ়রহম, ঝসঁমমষরহ. 
শব্দটির প্রচলিত অর্থ হচ্ছে, অন্যায় ও অবৈধ উপায়ে কোন জিনিস যথাযথ স্থান থেকে অন্যত্র সরিয়ে নেয়া। যেমন- আমরা অনেক সময় বলি, ঘর থেকে ঘড়িটি পাচার হয়ে গেছে অর্থাৎ কেউ ঘড়িটিকে অন্যত্র নিয়ে গেছে। আবার বলি, বাংলাদেশ থেকে জ্বালানী তেল পাচার হচ্ছে অর্থাৎ অবৈধ পদ্ধতিতে দেশ থেকে অন্যত্র পাঠিয়ে দেয়া হচ্ছে। এ ছাড়াও শব্দটি ক্রয়-বিক্রয় করা, স্থানান্তর, মানুষ সংগ্রহ ইত্যাদি অর্থে ব্যবহৃত হয়। 
১.২ নারী ও শিশু পাচার
নারী ও শিশুকে অন্যায় ও অবৈধভাবে তাদের বাসা বাড়ী থেকে দেশের অভ্যন্তরে কিংবা দেশের বাইরে পতিতাবৃত্তি বা শ্রম কাজের জন্য অর্থের বিনিময়ে পাঠিয়ে দেয়ার নাম নারী ও শিশু পাচার। 
যদিও সাধারণত আমরা পাচার বলতে নারী ও শিশুকে দেশের বাইরে অবৈধভাবে পাঠানোকে বুঝি। কিন্তু বাস্তবতার আলোকে বলা যায়, নারী ও শিশু পাচার দুই ধরনেরঃ
১. দেশের অভ্যন্তরে পাচার।
২. দেশের বাইরে পাচার।
নারী, শিশু, পুরুষ কিংবা যে কোন সম্পদই পাচারের শিকার হতে পারে। তবে নারী ও শিশুরাই অধিক পরিমাণে পাচারের শিকার হয়। কারণ নারী ও শিশুদের পাচার করা পাচারকারীদের জন্য তুলনামূলক নিরাপদ, কম ঝুঁকিপূর্ণ ও অধিক লাভজনক।
১.৩ ইতিহাসে নারী ও শিশু পাচার ঃ
নারী ও শিশু পাচারের মত জঘন্য অপরাধ শুধু যে বর্তমান বিশ্বে রিাজমান তা নয়, বরং প্রাচীনকাল থেকে একদল মানুষ এ অপরাধের সাথে জড়িত। পাচারের প্রতি নিন্দা জ্ঞাপন করে কুরআন ও সুন্নাহ-তে যে সব ঘটনার উল্লেখ রয়েছে তার দু’একটি ঘটনার বিবরণ নি¤œরুপ ঃ
১. পবিত্র কুরআনে আল্লাহ তা’আলা ইউসুফ আলাইহি সালাম-এর জীবনের বিস্তারিত ইতিহাস তুলে ধরেছেন। একটি পূর্ণাঙ্গ সূরার নামই হচ্ছে ইউসুফ। এ সূরাটিতে ইউসুফ আলাইহি সালাম যে পাচারের শিকার হন, সেটি তুলে ধরা হয়েছে। 
ঘটনার বিবরণ হল, ইউসুফ আলাইহিস সালাম-এর প্রতি তার পিতা ইয়াকুব আলাইহিস সালাম এর অতিরিক্ত ¯েœহ ও ভালবাসা তার সৎ ভাইদের প্রতিহিংসার কারণ হয়ে দাঁড়ালো। সৎ ভাইয়েরা ইউসুফ ‘ আলাইহিস সালামকে পিতার নৈকট্য থেকে বঞ্চিত হবার কারণ মনে করে তাকে হত্যা করার পরিকল্পনা করল। তার সকলে পরামর্শক্রমে ইউসুফ আলাইহিস সালামকে নির্জন এলাকার একটি কূপে নিক্ষেপ করল। ওদিকে হেজাজবাসী ইসমাঈলী বংশধরের একটি কাফেলা শাম থেকে মালামাল বোঝাই করে মিসরে যাচ্ছিল। পথিমধ্যে কূপ দেখে তারা পানির জন্য বালতি ফেলল। ইউসুফ আলাইহিস সালাম মরে করলেন, হয়ত ভাইদের অন্তরে দায়ার সঞ্চার হয়েছে। তাই তিনি বালতি ধরে ঝুলে রইলেন। ব্যবসায়ীগণ বালতি উঠিয়ে ইউসুফ ‘ আলাইহিস সালামে দেখে সজোরে বলে উঠল, ‘ইয়া বুশরা হাযা গুলাম’’ অর্থাৎ সুসংবাদ! এতো সুন্দর বালক। উক্ত ব্যবসায়ী দলের সাথে আরেক দল মিসরীয় ব্যবসায়ী সাক্ষাৎ হলো। তারা উক্ত বালকটিকে দাস হিসেবে ক্রয় করার জন্য আগ্রহ প্রকাশ করল। ব্যবসায়ীগণ মিসরীয়দের কাছে বিশটি মুদ্রার বিনিময়ে ইউসুফ আলাইহিস সালামকে বিক্রি করে দিল। অতঃপর মিসরীয় ব্যবসায়ী দল ইউসুফ আলাইহিসা সালামকে নিয়ে মিসরের একটি বড় বাজারে গমন করল, যেখানে দেশের রাজ-রাজন্য ও আমীর-উমারাগণ তথায় আগতমন করে থাকেন। বাজারে সেদিনও বহু রাজা-রাজন্যবর্গ উপস্থিত ছিলেন। ঐদিন বাজাারে মিসরের প্রধান উজীর আযীয মিসরও উপস্থিত ছিলেন। শেষ পর্যন্ত তিনি ধারণাতীত উচ্চ মুল্যে ইউসুফ আলাইহিস সালামকে ব্যবসায়ীদের নিকট থেকে ক্রয় করে বাড়িতে নিয়ে গেলেন। 
আল-কুরআনে আল্লাহ তাআলা এ ঘটনার বর্ণনা ইরশাদ করেন, ‘‘একটি কাফেলা এল এবং তাদের পানি সংগ্রাহককে প্রেরণ করল। সে বালতি ফেলল অত:পর বলে উঠল বাহ: এতো এক ফুটফুটে বালক! তারা তাকে পণ্যদ্রব্য গণ্য করে গোগন করে ফেলল। আল্লাহ তা’আলা তাদের কর্মকান্ডে ব্যপাওে খুবই জ্ঞাত। ওরা (ব্যবসায়ী) তাকে সামান্য কয়েকটি দিরহামের বিনিময়ে বিক্রি করে দিল। তারা ছিল তার ব্যাপারে নিরাসক্ত। 
কুরআনে বণিত এই ঘটনায় প্রমাণিত হয় যে, খৃষ্টপূর্বে কযেক হাজার বছর পূর্বেও পাচার কাজের সাথে একদল লোক জড়িত ছিল। ইউসুফ আলাইহি সালাম এর ভাইয়েরা স্বীয় স্বার্থ হাসিলের জন্য তার পিতাকে ফুসলিয়ে বালক ইউসুফকে নিয়ে এসে হত্যার ষড়যন্ত্র করল এবং কুপে নিক্ষেপ করল। অতপর একদল ব্যসসায়ী তাকে উদ্ধার করতে সক্ষম হলেও তারা ইউসুফ আলাইহিস সালামকে তার পিতার হাতে তুলে না দিয়ে বিক্রির ব্যবস্থা করল। এটা ছিল এক ধরনের পাচার। যদি তাই না হতো তবে তারা শিশু ইউসুফকে উদ্ধারের ঘটনা ফলাও করে প্রচার করত এবং তাকে তাঁর পিতার নিকট ফিরিয়ে দিতে চেষ্টা করত। 
২. শিশু পাচারের ঘটনা আইয়ামে জাহেলিয়্যাতেও দেখা যায়। যায়িদ ইবনুল হারিছা রাযিয়াল্লাহু আনহু-এর জীবনী থেকে জানা যায়, তিনিও শিশু বয়সে পাচারকারীদের কবলে পড়েছিলেন। দীর্ঘদিন তাকে দাস হিসেবে অমানবিক জীবন যাপন করতে হয়। ঘটনার বিবরণ হল, যায়িদ ইবনুল হারিছা রাদিয়াল্লাহু আনহু-এর জননী সাওদাহ বিনতে সা’লাবা তাঁর শিশু পুত্র যায়িদকে সঙ্গে করে পিতৃগোত্র বনী মানের নিকট যাওয়ার জন্য রওয়ানা হলেন। পিতৃগোত্র পৌঁছার পূর্বেই একদিন রাতে বনী কায়নের লুটেরা দল তাঁদের তাবু আক্রমণ করে ধন-সম্পদ, উট ইত্যাদি লণ্ঠন এবং শিশুদের বন্দী করে নিয়ে যায়। এই বন্দী শিশুদের মধ্যে তাঁর পুত্র যায়িদ ইবনুল হারিছা রাযিয়াল্লাহু ‘ আনহু ছিলেন। যায়িদের বয়স তখন আট বছর। লুটেরা দলটি তাঁকে বিক্রির উদ্দেশ্যে তদানীন্তন আরবের প্রসিদ্ধ উকাজ মেলায় নিয়ে যায়। হাকীম ইবন হিযাম ইবন খুয়াইলিদ নামে এক কুরাইশ নেতা চারশ’ দিরহামে তাকে ক্রয় করেন। তাঁর সাথে আরো কিছু দাস ক্রয় করে তিনি মক্কায় ফিরে আসেন। 
হাকিম ইবন হিযামের প্রত্যাবর্তনের খবর শুনে তার ফুফু খাদিজা বিনতে খুয়াইলিদ রাযিয়াল্লাহু আনহা দেখা করতে আসেন। ফুফুকে তিনি বলেন, ফুফু! উকাজ থেকে আমি বেশ কিছু দাস ক্রয় করে এনেছি। এদের মধ্যে যেটা আপনার পছন্দ কহয় বেছে নেন। আপনাকে হাদিয়া বা উপহার হিসেবে দান করলামা। খাদিজা রাযিয়াল্লাহু ‘ আনহা দাসগুলোর চেহারা অবলোকন করার পর যায়িদ ইবনুল হারিছাকে পছন্দ করেলেন। কারণ তিনি যায়িদের চেহারায় তীক্ষè মেধা ও বুদ্ধির ছাপ প্রত্যক্ষ করেছিলেন। তিনি তাঁকে সঙ্গে করে বাড়িতে নিয়ে এলেন। 
এ ঘটনার কিছু দিন পর রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর সাথে খাদিজা রাযিয়াল্লাহু আনহা পরিণয়সূত্রে আবদ্ধ হলেন। তিনি স্বামীকে কিছুু উপহার দেওয়ার ইচ্ছা করলেন। যায়িদ ইবনুল হারিছা রাযিয়াল্লাহু আনহু অপেক্ষা অধিকতর সুন্দর কোন কিছু তিনি খুঁজে পেলেন না। তাকেই তিনি স্বামীর হাতে তুলে দিলেন। 
এ সৌভাগ্যেবান বালক ক্রীতদাস প্রিয়নবী মুহাম্মদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লা-এর তত্ত্বাবধানে প্রতিপালিত হতে লাগলেন। তাঁর মহান সাহচার্য লাভ করে উত্তম চরিত্রিক সৌন্দর্য পর্যবেক্ষণ সুযোগ পেলেন। এ দিকে তাঁর ¯েœহময়ী জননী পুত্র হারানোর শোকে অস্থির হয়ে পড়লেন, তার চোখে পানি কখনও শুকাতো না। রাতের ঘুম তার হারাম হয়ে গিয়েছিল। যায়িদ রাযিয়াল্লাহু আনহু-এর পিতা হারিছা সম্ভাব্য সব স্থানে পাচার হয়ে যাওয়া হারানো ছেলেকে খুঁজতে থাকেন। পরিচিত প্রতিটি মানুষের কাছে ছেলের সন্ধান জানতে চাইলেন। তিনি ছিলেন তৎকালীন আরবেএকজন বিশিষ্ট কবি। এ সময় রচিত বহু কবিতায় তাঁর সন্তান হরানোর বেদনা মুর্ত হয়ে উঠেছে। একটি কবিতায় তিনি বলেন ঃ 
যায়িদের জন্য আমি কাঁদছি, জানিনে
তার কি হয়েছে, সে কি জীবিত?
তবে তো ফেরার আশা আছে, নাকি মারা গেছে?
আল্লাহর কসম! আমি জানিনা, অথচ জিজ্ঞেস করে চলেছি। 
তোমাকে অপহরণ করেছে সমতল ভূমির লোকেরা, না পার্বত্য ভূমির?
উদয়ের সময় সূর্য স্মরণ করিয়ে দেয় তার কথা,
আর যখন অস্ত যায়, নতুন করে মনে করিয়ে দেয়। 
আমি দেশ থেকে দেশান্তরে তোমার সন্ধানে 
উট হাঁকিয়ে ফিরবো, কখনও আমি ক্লান্ত হবো না, 
আমার বাহন উটও ক্লান্ত হবে না। আমার জীবন থাকুক বা মৃত্যু আসুক। 
এক হজ্জ মৌসুমে যায়িদের গোত্রের কতিপয় লোক হজ্জের উদ্দেশ্যে মক্কায় এলো। কা’বার চতুর্দিকে তাওয়াফ করার সময় তারা যায়িদের মুখোমুখি হলো। তারা একে অপরকে চিনতে পেরে কুশল বিনিময় করলো। হজ্জ আদায় শেষে তারা এলাকায় প্রর্তাবর্তন করে যায়িদের পিতা হারিছাকে তাঁর হারানোর ছেলে সন্ধান দিল। তিনি ছেলেকে খুঁজে পেলেন। রাসূল সাল্লাল্লাহু ‘ আলাইহ ওয়াসাল্লাম যায়িদের পাচার হয়ে যাবার অজানা কাহীনি
জেনে অত্যন্ত ব্যথিত হলেন এবং তার পিতার সঙ্গে বাড়ী ফিরে যাবার অনুমতি দিলেন। কিন্তু
কিন্তু যায়িদ রাসূল সাল্লাল্লাহু ‘ আলাইহিস ওয়াসাল্লাম-এর আচরণে এতটা ম্গ্ধু হয়ে পড়েছিলেন যে, তিনি পিতার সাথে বাড়ী ফিরে না গিয়ে রাসূল সাল্লাল্লাহু ‘ আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর সাহচর্যকে অগ্রাধিকার দিলেন। রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম খুশী হয়ে তাকে স্বাধীন করে দিলেন। 
১.৪ বর্তমান যুগে নারী পাচার ও শিশু পাচার
নারী ও শিশু পাচারের মত জঘন্য অপরাধের প্রবণতা পূর্বেও ছিল, বর্তমানেও আছে। তবে বর্তমানে এর বিস্তার এত বেশী যে, তা সামাল দেয়া কঠিন হয়ে পড়েছে। বতমান যুগে অর্থ উপার্জনে সহজ মাধ্যমে হিসেবে একদল অপরাধী লোক পাচার করার কাজকে পেশা হিসেবে গ্রহণ করেছে। পাচারের জন্য তারা নতুন কৌশল আবিষ্কার করছে। নতুন নতুন পরিভাষা আর চটকদার কথার মাধ্যমে তারা নারী ও শিশু পাচারের মত জঘন্য কার্যক্রম চালিয়ে যাচ্ছে। বাংলাদেশের নারী ও শিশু পাচারে ঘটনা মাঝে মধ্যে পত্র-প্রত্রিকায় প্রকাশিত হয়। যেমন-ডেইলি ষ্টার পত্রিকায় প্রকাশিত একটি প্রতিবেদনে ‘আযাদ’ নামক এক শিশুর আরব আমিরাতে পাচার হওয়া এবং উটের জকি হিসেবে দশ বছর যাবৎ কাজ করার এক লোমহর্ষক কাহিনী প্রকাশিত হয়। ১৮ তাছাড়া দৈনিক জনকণ্ঠ পত্রিকায় ১৪ ফেব্রুয়ারী ২০০৬ এ প্রকাশিত নুর জাহান নাুী এক মহিলার সিংগাপুর পাচার হওয়া এবং তাকে নিয়ে নারী ব্যবসায়ীদের ভীতিকর কাহিনী বর্তমান যুগের পাচারের এক উল্লেখযোগ্য ঘটনা।

১.৫ পাচারের উদ্দেশ্য
নারী ও শিশু পাচারের পেছনে কোন মহৎ উদ্দেশ্য জড়িত নেই একথা সর্বজনবিদিত। অর্থ উপার্জনই পাচারের মূল লক্ষ্য। পাচারকারীদের নিকট অর্থ উপার্জনই বড় কথা। তা ন্যায় পথে হচ্ছে কি অন্যায় পথে সেটিকে তারা বড় করে দেখে না। 
১.৬ পাচারের কৌশল 
পাচারকারীরা নারী ও শিশু পাচারের ক্ষেত্রে নতুন নতুন কৌশল অবলম্বন করে। তারা এমন বিষয়ের প্রলোভন দেখায় যাতে নারী কিংবা শিশুর অভিভাবক শিশু ও নারীকে স্বেচ্ছায় তাদের হাতে তুলে নেয়। কখনও কখনও অপহরণ করে কিংবা চুরি করে পাচার করে দেয় পাচারকারীরা। যেখান থেকে বেরুবার কোন পথ থাকে না। যে সব প্রলোভন দেখিয়ে নারী ও শিশু পাচার করা হয়, তার অন্যতম হলঃ
১. চাকুরীতে প্রতিষ্ঠার প্রলোভন। 
২. বিদেশ গমন ও অর্থ উপার্জনের প্রলোভন। 
৩. বিয়ে করার প্রলোভন। 
৪. দেশ ভ্রমণ/দর্শনীয় স্থান পরিদর্শন প্রলোভন।
৫. শিশুর অভিভাবককে অর্থ প্রদানের প্রলোভন। 
এছাড়াও পাচার করার জন্য তারা আরো দু’টি পথ অবলম্বন করে থাকে-
১. অপহরণ / ভয়ভীতি দেখিয়ে ও শক্তি প্রয়োগ করে ধরে নিয়ে যাওয়া। 
২. চুরি করে নিয়ে পাচার করা। 
১.৭ যে সব পরিস্থিতির সুযোগ নিয়ে পাচার করা হয়
গোটা বিশ্বে বিশেষ করে বাংলাদেশে যে সব নারী ও শিশু পাচার হচ্ছে তাদের অনেকেই যে, তাদেরকে পাচার করে নিয়ে আসা হয়েছে। অনেক সময় তারা বুঝে উঠতে পারে না কি করানো হবে তাদেরকে দিয়। পাচারকারীরা নারী ও শিশুদের পাচার করার জন্য বিভিন্ন সুযোগের অপেক্ষা থাকে। পরিবেশ-পরিস্থিতি বুঝে কৌশল গ্রহণ করে তারা। সাধারণত যে সব পরিবেশ ও পরিস্থিতি সুযোগ নিয়ে তারা নারী ও শিশু পাচার করে তার কয়েকটি দিক এখানে তুলে ধরছি ঃ
১. অজ্ঞতা, মুর্খতা ও অসচেতনতা ঃ নারী ও শিশুর অভিভাবকদের একটি বিরাট অংশ মুর্খ-অজ্ঞ এবং অসচেতন। তারা সহজ ও সরল জীবন যাপন করে। চতুর ধরনের লোকজনকে বিশ্বাস করে তার। তারা ঐসব ব্যক্তিদের কাছে মনের কথা বলে, সুবিধা-অসুবিধা বর্ণনা দেয়। পাচারকারীদের অনেকে এ সুযোগ কাজে লাগায়। তারা সরলতার সুযোগ নিয়ে বিভিন্ন ধরনের লোভ দেখিয়ে নারীদের নিয়ে যায় অন্যত্র। শিশুদের অভিভাবকদের সম্মতি নিয়ে তারা পাচার করে শিশুদের। ইসলাম সকল মানুষকে জ্ঞানী ও সচেতন হতে নির্দেশ প্রদান করেছে। রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি সালাম বলেন, প্রত্যেক মুসলিমের উপর জ্ঞানার্জন করা বাধ্যতামুলক। ইসলামী নির্দেশনার আলোকে অভিভাবকরা সচেতন হলে পাচারকারীরা তাদের কন্যা কিংবা শিশুদের পাচার করার সুযোগ গ্রহণ করতে পারত না। 
২. নারীদের প্রতি নির্যাতন ঃ আমাদের সমাজের নারীরা বিভিন্নভাবে নির্যাতিত। ইসলাম তাদের যে সব মর্যাদা দিয়েছে তার যাথাযথ প্রয়োগ আমাাদের সমাজে বিদ্যমান নেই। ফলে কারণে বা অকারণে তালাক অথবা বিবাহ বিচ্ছেদদের শিকার হচেছ মেয়েরা। তাদেরকে ঘর থেকে, সংসার থেকে বের করে দেবার ঘটনা ঘটছে। শারীরিক ও মানসিক নির্যাতনে শিকার হচেছ তারা। এ ধরনের নির্যাতিত নরীদেরকে সহানূভুতির ছদ্মাবরণের কাছে টেনে নেয়ার অপেক্ষায় থাকে পাচারকারীরা। তারপর সুযোগ বুঝে তাদের করে অন্যত্র। 
৩. সংকীর্ণ কর্মক্ষেত্র ঃ আমাদের দেশে সমস্যাগ্রস্থ নারীদের কর্মক্ষেত্রে অনেকটা সংকীর্ণ। সুন্দর পরিবেশে ইসলামী মূল্যবোধসহ সকল মেয়ের কাজ করার মত পরিবেশ বাংলাদেশে তৈরী হয়নি বললেই চলে। তৈরী পোষাক শিল্পের সুবাদে কিছুটা সুযোগ সৃষ্টি হলেও প্রয়োজনের তুলনায় কম। ফলে সমস্যাগ্রস্থ মহিলারা কাজ না পেলে আরো হতাশাগ্রস্থ হয়। পাচারকারীরা সে সুযোগ গ্রহণ করে এবং তাদের পাচার করে নিয়ে যায়। 
৪. দরিদ্র ঃ নারী ও শিশু অভিভাবকের দারিদ্রকে পাচারকারীকে তাদের জন্য সবচেয়ে বড় পুঁজি মনে করে। তার নারীদের পয়সার লোভ দেখায়, নগদ টাকা দেয়। শিশুর অভিভাবকদের নগদ অর্থ প্রদানের মাধ্যমে সংসারে স্বচ্ছলতা আনয়নের কথা বলে পাচার কার্য সম্পাদন করে। ইসলাম বেশী সম্পদ পুঞ্জিভুত করা পছন্দ করে না সত্য। তাই বলে দারিদ্রকে লালন করতে বলেনি। বরং বিভিন্ন হাদীসে রাসূল সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়াসাল্লাম দারিদ্র থেকে সতর্ক থাকতে পরামর্শ দিয়েছন। রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম একটি হাদীসে বলেন, ‘‘কখনও কখনও দারিদ্র মানুষকে কুফরীর দিকে ধাবিত করতে পারে’’। ইসলামের শিক্ষা অনুযায়ী অভিভাবকরা দারিদ্রের ব্যাপারে সচেতন থাকলে এটিকে পুঁজি করে পাচারকারীদের পক্ষে তাদের ব্যবসা এতটা চালিয়ে যাওয়া নিঃসন্দেহে সম্ভব হত না। 
৫. অপরিকল্পিত পরিবার ঃ বাংলাদেশে অধিকাংশ পরিবার প্রধানত অশিক্ষিত, অল্প শিক্ষিত ও অসচেতন। পরিবার গঠনের ব্যাপারে ইসলাম যে ধারণা পেশ করেছে তারা সে সম্পর্কে অবগত নয়। তাই অপরিকল্পিতভাবে পরিবার গঠন করছে তারা। সন্তনের প্রতি যথার্থ দায়িত্ব পালন করতে পারছে না তারা। তাই অনেকে শিশুর জীবনে নেমে আসে দুঃখ বেদনা। এসব শিশুদের বেছে নেয় পাচারকারীরা। চাকুরীর নামে ঝুকিপূর্ণ কাজের জন্য নিয়োগ করে তাদের, বিক্রি করে দেয় অন্যের কাছে। 
ইসলামের নবী মুহাম্মদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বিভিন্ন বক্তব্যে পরিকল্পিত পরিবার গঠনের প্রতি ইঙ্গিত করেছেন। তিনি এক হাদীসে বলেন, ‘‘আমি আল্লাহর নিকট’ জাহদুল বালা’ থেকে আশ্রয় চাই।’’ অনেকে জাহদুল বালা শব্দের অর্থ করেছেন, দরিদ্র অবস্থায় সন্তান সংখ্যা অধিক হওয়া। 
৬. আইন প্রয়োগে নমনীয় মনোভাব ঃ নারী ও শিশু পাচার রোধে আমাদের দেশে ২০০০ সনে একটি আইন হয়। তা সংশোধন করে নারী ও শিশু নির্যাতন সংশোধনী আইন ২০০৩ নামে আরো একটি আইন হয় যাতে নারী ও শিশু পাচার রোধে কঠোরতম শাস্তির বিধান রাখা হয়েছে। আইনে বলা হয়েছে, ‘‘পাচারকারীর সর্বোচ্চ শাস্তি মৃত্যুদন্ড বা যাবজ্জীবন কারাদন্ড বা অনধিক ২০ বৎসর; তবে ১০ বছরের কম নয় সশ্রম কারাদ- এবং অর্থদ- হতে পারে। আইনটি খুবই সুন্দর এবং যথার্থ। কিন্তু সমস্যা হচ্ছে, তদন্ত থেকে শুরু করে সর্বত্র দুর্নীতির কালো থাবা এমনভাবে গ্রাস করে আছে যে উল্লেখিত আইনের সঠিক প্রয়োগ অনেক ক্ষেত্রে সম্ভব হয়ে ওঠে না। পাচারকারীরা এ সুযোগটি গ্রহণ করে এবং বিভিন্নভাবে তাদরে অন্যায় কাজ অব্যাহ রাখে। 
২.০ ইসলামী আইনে নরী ও শিশু পাচারের বিধান
২.১. পাচার একটি জঘন্য যুলুম ও গুরুতর অপরাধ 
নারী ও শিশু পাচার একটি জঘন্য অপরাধ। এটি একটি মহা অন্যায়। পৃথিবীর সকল ‘ আলিমগণের ঐক্যমত্যে এটি হারাম কাজ। কোন মানুষের জন্য অন্য মানুষের সম্মান ও মর্যাদা হরণ করার সুযোগ নেই।্ এ সম্পর্কে রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেন, তোমাদের এ শহরে আজকের দিন ও এ মাসের মতই তোমাদের পরস্পরের মধ্যে তোমাদের জীবন, সম্পদ ও সম্মান সম্মানীয়। 
প্রত্যেক মানুষকে সম্মান ও মর্যাদার সাথে চলতে দিতে হবে। এটা তার অধিকার। পাচারের মাধ্যমে ব্যক্তির স্বাধীনতাভাবে চলার অধিকারকে হরণ করা হয়। তাছাড়া পাচারকারীরা মহিলা ও শিশুকে সাধারণতঃ যে সব কাজে নিয়োজিত করে তার অধিকাংশ ক্ষেত্রে শরী’আত সম্মত নয়। তাই এ অপরাধের সাথে জড়িত প্রায় সব ও ধোঁকাবাজকে একটি শীর্ষস্থানীয় অপরাধ হিসেবে সাব্যস্ত করে আল্লাহ্ তা’আলা ইরশাদ করেন, ‘‘আর এভাবেই আমি প্রত্যেক জনপদে এর শির্ষস্থানীয় অপরাধী লোকদেরকে এমনই করেছি যেন তারা নিজেদের ধোঁকা, প্রতারণা ও ষড়যন্ত্রের জাল বিস্তার করে।’’ রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেন, ‘‘ যে ব্যক্তি প্রতারণা করে, সে আমাদের অন্তর্ভুক্ত নয়।’’ 
চুরির মাধ্যমে যখন পাচার করা হয় তখন সেটি আরেকটি হারাম কাজ। ইসলামের দৃষ্টিতে চুরি করা একটি বড় অপরাধ। তাই চোরকে আল্লাহ কঠিন শস্তি দিতে নির্দেশ করে বলেন, ‘‘চোর পুরুষ হোক কিংবা নারী হোক, তার কর্মফল হিসেবে এবং আল্লাহর পক্ষ থেকে লাঞ্ছনা স্বরূপ তাদের হাত কেটে দাও।’’ রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেন, ঐ চোরের উপর আল্লাহর অভিসম্পাত যে সামান্য ডিম কিংবা রশি চরি করতে করতে এমন চোরে পরিণত হয় যার ফলে তার হাত কর্তন করা হয়।’’ 
আবার যখন অপহরণ করে পাচার করা হয় তখন তা আরেকটি হারাম কাজ। অপহরণ শরী’আতের দৃষ্টিতে একটি জঘন্য অপরাধ। তাই ইসলামে অপহরণের শাস্তি অত্যন্ত কঠিন। 
পাচারের ক্ষেত্রে সাধারণত চুরি ও প্রতারণই প্রধান কৌশল হিসেবে অনুসৃত হয়ে থাকে। এ ক্ষেত্রে যে কৌশলই অবলম্বন করা হোক না কেন, সর্বাস্থায় ইসলাম পাচারকে নি¤œবর্ণিত বিশেষণে বিশেষায়িত করেছেঃ
১. এটি একটি যুলুম ও অন্যায় কাজ। 
২. এটি একটি ফাসাদ ও বিপর্যয়মূলক কাজ। 
৩. এতে নারী ও শিশুর জান ও মালের প্রতি পাচারকারী ব্যক্তি চড়াও হয়ে থাকে। 
৪. এট অন্যকে কষ্ট দেয়ার শামিল। 
৫. এতে অন্যের জীবন ও সম্মানের মারাত্মক ক্ষতি করা হয়ে থাকে। 
৬. পাচার মানবতা বিরোধী একটি গুরুতর অপরাধ। 
৭. পাচার একটি অসামাজিক ও গর্হিত অপরাধ। 
২.২. যে সব উদ্দেশ্যে নারী ও শিশু পাচার করা হয় সে ব্যাপারে ইসলামের অবস্থান
সাধারণত ঃ যে সব উদ্দেশ্যে নারী ও শিশু পাচার করা হয় সে গুলো নিুরুপ ঃ
নারীদের ক্ষেত্রে 
১. বিক্রির উদ্দেশ্যে ( পতিতালয়ে কিংবা বিদেশী পর্যটকদের কাছে)
২. সরাসরি দেহ ব্যবসায় নিযুক্ত করার উদ্দেশ্যে (পতিতালয় কিংবা ধনী ব্যক্তির রক্ষিতা হিসেবে)
৩. প্রর্ণোগ্রাফি ছবি তৈরির জন্য। 
৪. মাদকদ্রব্যের ব্যবসা পরিচালনা।


শিশুদের ক্ষেত্রে
১. নি:সন্তান দম্পত্তির কাছে বিক্রি করা। 
২. হত্যা করে শরীরের বিভিন্ন অঙ্গ প্রতঙ্গ বিক্রি করা। 
৩. বিকলাঙ্গ করে ভিক্ষাবৃত্তিতে বাধ্য করা। 
৪. ঝুঁকিপূর্ণ শ্রমে নিয়োগ করা। 
৫. মাদাক পাচার ও চোরাচালানীর কাজে ব্যবহার করা। 
৬. উটের জকি হিসেবে ব্যবহার। 
যে সকল উদ্দেশ্যে নারী ও শিশু পাচার করা হয় ইসলাম তার একটি কাজকেও সমর্থন করে না। এ ধরনের প্রত্যেকটি কাজ ইসলামের অবৈধ ও শস্তিযোগ্য অপরাধ। নি¤েœ সংক্ষিপ্তভাবে তুলে ধরা হলো ঃ
২.৩ নারী ও শিশু বিক্রি করা
কোন মানুষকে (নারী কিংবা শিশু যাই হোক না কেন) বিক্রি করা ইসলামে জায়েয নেই। এমনকি নিজের সন্তানকেও কেউ বিক্রি করার অধিকার রাখে না। কারণ পৃথিবীর সকল আলিমগণ এ মর্মে ঐক্যমত পোষণ করেন যে, মানুষ ঐসব বস্তু বিক্রি করতে পারবে না যার উপর তার মালিকানা এবং কর্তৃত্ব নেই। 
তাছাড়া মানুষ সম্মানীত। আল্লাহ তাকে সম্মান দিয়ে সৃষ্টি করেছেন। আল্লাহ বলেন, ‘‘আমি আদম সন্তানকে সম্মানিত করেছি।” অতএব মানুষকে বিক্রি করলে তার সম্মানের হানী করা হয়। তাই ইসলামী আইনজ্ঞরা মানুষ বিক্রি করাকে হারাম হলে অভিহিত করেছেন। 
২.৪. দেহ ব্যবসা 
ইসলামের দৃষ্টিতে কোন নারীর জন্য স্বেচ্ছায় নিজেকে দেহ ব্যবসা নিয়োজিত করা হারাম। অন্য কেউ তাকে দিয়ে দেহ ব্যবসা পরিচালনা করতে চাইলে তাও হারাম। এ সম্পর্কে আল্লাহ বলেন, ‘‘তোমরা যুবতীদের দেহ ব্যবসায় লিপ্ত হতে বাধ্য করো না। তিনি অন্যত্র বলেন, ‘‘তোমরা ব্যভিচারের নিকটবর্তী হইও না। কেননা তা নোংরামী ও নিকৃষ্ট পথ।” নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেন, কোন ব্যক্তি মু’মিন থাকা অবস্থায় ব্যভিচারে লিপ্ত হতে পারে না। বর্ণিত প্রমাণাদি ব্যভিচার ও দেহ ব্যবসাকে অত্যন্ত বলিষ্ঠার সাথে নিষিদ্ধ ঘোষণা করেছে। 
২.৫. পর্ণোগ্রাফি ছবি তৈরী
প্রর্ণোগ্রাফি ছবি তৈরী করা ও অশ্লীলতা ও অসুস্থ মানসিকতা ফসল। যুবকদের চরিত্র হনন করাই এর মূল উদ্দেশ্য। ইসলাম যে কোন প্রকার অশ্লীলতা নিকটবর্তী হতেও নিষেধ করেছে। আল্লাহ বলেন, ‘‘তোমরা কোন ধরনের প্রকাশ্য কিংবা অপ্রকাশ্য অশ্লীল কাজের নিকটবর্তী হয়ো না।” 
২.৬. হত্যা করে বিভিন্ন অঙ্গ বিক্রি করা
এখানে যুগপৎ দু’টি ভায়াবহ অপরাধ লক্ষ্যণীয় –
এক ঃ হত্যা করা। 
ইসলামে হত্যা হচ্ছে জঘন্য অপরাধ। এ সম্পর্কে আল্লাহ তা’আলা ইরশাদ করেন, ‘‘কিসাস ব্যতীত অন্য কোর কারণে কিংবা পৃথিবীতে বিপর্যয় সৃষ্টির লক্ষ্যে যদি কেউ অন্য কাউকে হত্যা করে তবে সে যেন গোটা মানবজাতীকে হত্যা করল।” 
দুই ঃ অঙ্গ-প্রতঙ্গ বিক্রি করা। 
শরীরের কোন অঙ্গ-প্রত্যঙ্গ যেমন, কিডনী, কর্নিয়া, ব্লাড ইত্যাদি ব্যক্তি তার নিজের প্রয়োজনেও বিক্রি করতে পারবে না। কেননা ইসলামের দৃষ্টিতে এগুলো বিক্রি করা অবৈধ ও হারাম। এর দলীল হল ঃ
ক. পৃথিবীর সকল আলিম এ মর্মে ঐকমত্য পোষণ করেণ যে, ঐসব বস্তু বিক্রি করতে পারবে না যার উপর তার মালিকানা এবং কর্তৃত নেই। মানুষের প্রত্যেকটি অঙ্গ-প্রতঙ্গ মালিকানা মূলত: আল্লাহ তাআলার। তাই তা বিক্রি করা বৈধ নেই। 
খ. মানুষ সৃষ্টির মাঝে সবচেয়ে বেশী সম্মানিত। আল্লাহ তাআলা বলেন, আমি আদম সন্তানকে সম্মানিত করেছি। তাই মানুষের প্রত্যেক অঙ্গ-প্রতঙ্গ সম্মানিত। সে গুলোকে বিক্রি করলে সম্মানের হানী করা হয়, যা শরয়ী’আতের মাকাসিদ ও উদ্দেশ্যর বিপরীত। তাই ইসলামী আইনজ্ঞগণ মানুষের অঙ্গ-প্রতঙ্গ বিক্রি করাকে হারাম বলে মত প্রকাশ করেন। 
ব্যক্তির নিজের জন্য স্বীয় অঙ্গ-প্রতঙ্গ বিক্রি করা হরাম হলে অন্য ব্যক্তির জন্য সেই অঙ্গ-প্রতঙ্গ নিয়ে ব্যবসা করা যে কতটা গুরুতর অপরাধ তা সহজেই অনুমান করা যায়। আর তা যদি হয় পাচারকৃত কোন শিশু বা নারীর, তাহলে সেটি হচেছ সর্বোচ্চ পর্যায়ে অপরাধ। 
২.৭. অঙ্গহানী করে ভিক্ষাবৃত্তিতে নিয়োগ 
এখানেও দু’টি ভয়াবহ অপরাধ লক্ষ্যণীয়। 
এক ঃ অঙ্গহানী 
ইসলামের দৃষ্টিতে অঙ্গহানী করা জঘন্যতম অপরাধ। একমাত্র চিকিৎসা উদ্দেশ্য ছাড়া অঙ্গহানী করা যবে না। অঙ্গহানীর জন্য ইসলামের কঠিন শাস্তির বিধান রাখা হয়েছে। আল্লাহ তা’আলা ইরশাদ করেন, ‘‘ আমি তাদের উপর জীবনের পরিবর্তে জীবন, চোখের পরিবর্তে চোখ, নাকের পরিবর্তে নাক, কানের পরিবর্তে কান, দাতের পরিবর্তে দাত এবং ক্ষত-বিক্ষত হলে কিসাস (বদলা) গ্রহণ করা ফরয করে দিয়েছি। 
দুই ঃ ভিক্ষাবৃত্তি 
ইসলামের দৃষ্টিতে ভিক্ষাবৃত্তি একটি অবমাননাকর পেশা। ইসলাম এ বৃত্তিকে পেশা হিসেবে গ্রহণ করতে ব্যাপকভবে নিরুৎসাহিত করেছে। এ ব্যাপারে নবী মুহাম্মদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর শিক্ষা সর্বজনবিদিত। সে শিক্ষার আদর্র্শ কবিতার তুলিতে কবি এভাবে তুলে ধরেছে- ‘‘নবীর শিক্ষা করোনা ভিক্ষা, মেহনত কর সবে।’’ অবশ্য নিত্যান্ত প্রয়োজন কোন কিছু চাওয়ার অনুমতি দিয়েছে ইসলাম। হাদীস শরীফে ভিক্ষাবৃত্তিকে নিরুৎসাহিত করে বলা হয়েছে, দানকারী ব্যক্তি দান গ্রহণকারীর চেয়ে উত্তম। যেখানে কোন ব্যক্তির নিজের সাধারণ প্রয়োজন ভিক্ষাকে বৃত্তি হিসেবে গ্রহণ কতরা বৈধ নয়, সেখানে অন্য কাউকে তা করতে বাধ্য করে ব্যবসা চালু করা ইসলামের দৃষ্টিতে কত বড় অপরাধ তা অত্যন্ত সুুস্পষ্ট।
২.৮. ঝুঁকিপূর্ণ কাজে নিয়োগ 
ইসলাম শিশুদের প্রতি সদয় আচরণ করার নির্দেশ দিয়েছে। রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম গোটা বিশ্ববাসীর প্রতি সে ফরমান জারী করে বলেন, যে ব্যক্তি ছোটদের ¯েœহ করে না আর বড়দের সম্মান করে না সে আমার উম্মতের অন্তর্গত নয়। 
শিশুদের প্রতি সদয় আচরণের দৃষ্টান্ত হিসেবে ইসলাম তাদের উপর কোন প্রকারের ‘ইবাদত ফরয কনে দেয়নি। কারণ প্রতিটি ‘ ইবাদতে কম-বেশী কষ্ট বিরাজমান। তাই শিশুদের ঝুঁকিপূর্ণ কাজে নিয়োজিত করা ইসলামের মূলনীতির সাথে সঙ্গতিপূর্ণ নয়। অতএব তাদের ঝুঁকিপূর্ণ কাজে কাজে লাগানোও অবৈধ। 
২.৯. মাদকদ্রব্য পাচার ও চোরাচালানী
ইসলাম মাদকদ্রব্যের ব্যবহার, আদান-প্রদান ও বিক্রি-এ সব কিছুকেই নিষিদ্ধ করেছে। মহান আল্লাহ বলেন, ‘‘(হে রাসূল!) লোকেরা আপনাকে মদ ও জুয়া সম্পর্কে জিজ্ঞাসা করে। আপনি বলুন, এ দুটোতো অনেক বড় ক্ষতি যেমন রয়েছে তেমনি রয়েছে উপকার। তবে ক্ষতির দিকটা উপকারের চেয়ে অনেক বেশী।’’ নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেন, ‘‘প্রত্যেক নেশাজাত দ্রব্য মদ এবং প্রত্যেক নেশাজাত দ্রব্য হারাম।’’ 
তাছাড়া চোরাচালানী একদিকে যেমন, চুরি, অন্যদিকে তা দেশদ্রোহীতার শামিল, ইসলামে এ দুটোই কবীরা গোনাহ হিসেবে গণ্য। 
২.১০. উটের জকি হিসেবে ব্যবহার 
এটি একটি জাহেলিয়াত। অত্যন্ত ঝুঁকিপূর্ণ কাজ এটি। স্বাভাবিক মানবতাবোধ থাকলেও মানুষ শিশুদেরকে জকি হিসেবে ব্যবহার করতে পারে না। আমারা ইতোপূর্বে আলোচনা করেছি যে শিশুদের ঝুঁকিপূর্ণ কাজে নিয়োজিত করা বৈধ নয়। যেসব কারণে শিশুদের ঝুঁঁকিপূর্ণ কাজে নিয়োজিত করা বৈধ নয় ঠিক সেসব কারলেণ তাদেরকে উটের জকি হিসেবে করা অবৈধ। উপরন্ত এ ধরনের কাজ করানো যুলুম, অন্যায়। শরীআতে যুলুম একটি গুরুতর অপরাধ। 
২.১১. ইসলামী আইন পাচারের শাস্তি
ইসলামী শরীআতে যে কোন অপরাধের জন্য দু’ধরনের শাস্তির প্রতি ভয় প্রদর্শন করে। 
১. আখিরাতের শাস্তি। ২. পার্থিব শাস্তি। 
ইতোপূর্বে বর্ণিত আলোচনায় প্রমাণিত হয়েছে যে, পাচার করা হরাম। এজন্য আখিরাতে কঠিন শাস্তি নির্ধারিত। মহান আল্লাহ বলেন, ‘‘ হ্যাঁ যে ব্যক্তি পাপ অর্জন করেছে এবং সে পাপ তাকে পরিবেষ্টিত করে নিয়েছে, তারাই দোযখের অধিবাসী। তারা সেখানেই চিরকাল অবস্থান করবে। 
পৃথিবীতে শান্তি-শৃঙ্খলা রক্ষার জন্য বিধান রয়েছে ইসলামে। অপরাধগুলোকে শাস্তির স্তর দিন ভাগে ভাগ করা হয় ঃ 
১. الحدود (হুদুদ) সংক্রান্ত অপরাধ। 
২ القصاص والدية ( কিসাস ও দিয়াহ) সংক্রান্ত অপরাধ। 
৩. التعزير (তা’যীর) সংক্রান্ত অপরাধ। 
جرائم الحدود হুদুদ সংক্রান্ত অপরাধ বলতে ঐসব অপরাধকে বুঝায় যর জন্য আল্লাহ তা’আলা সুনির্দিষ্ট পরিমাণ শাস্তি নির্ধারণ করে দিয়েছেন। এ ধরনের অপরাধ প্রমাণিত হলে সরকার কিংবা মযলুম কিংবা তার ওয়ারিশেরও তা ক্ষমা করার অধিকার থাকে না। এ ধরনে অপরাধ সাতটি। 
১. ব্যভিচার।
২. মদ্যপান। 
৩. চুরি। 
৪. ডাকাতি/ছিনতাই/অপহরণ করা। 
৫. মিথ্যা অপবাদ। 
৬. ধর্ম ত্যাগ। 
৭. বিদ্রোহ /রাষ্ট্রদ্রোহীতা। 
جرائم القصاص والدية বা কিসাস ও দিয়াত সংক্রান্ত অপরাধ বলতে ঐসব অপরাধকে বুঝায় যার জন্য হুবহু অপরাধ পরিমাণ প্রতিশোধ গ্রহণ কিংবা নির্ধারিত জরিমানা গ্রহণ করার সুযোগ রয়েছে। মযলুম ব্যক্তি নিজে কিংবা তার ওয়ারিশগণ যা ক্ষমা করে দেবার অধিকার রাখে। 
এ ধরনের অপরাধ ৫টি
১. ইচ্ছাকৃত হত্যা।
২. প্রায় ইচ্ছাকৃত হত্যা। 
৩. ভুলে হত্যা। 
৪. ইচ্ছাকৃত শারীরিকভাবে আহত করা। 
৫. ভুলে শারীরিক ক্ষতি সাধন করা। 
جرائم التعزير বা তা’যীর সংক্রান্ত অপরাধ হচ্ছে ঐসব অপরাধ যার ব্যাপারে শারী’আত সুনির্দিষ্টভাবে কোন শাস্তির উল্লেখ করেনি, যা নির্ধারিত করার ক্ষমতা সরকারকে করা হয়েছে। দেশ ও জনগণের কল্যাণে সরকার জনসাধারণকে সতর্ক করা থেকে শুরু করে শাস্তির ভয়াবহতা অনুযায়ী সবশেষ মৃত্যুদন্ড পর্যন্ত যে সুদ, ঘুষ, প্রতারণা, গালমন্দ করা ইত্যাদি। বিচারক এসব অপরাধে ধরন ও অবস্থায় উপর কম বা বেশী শাস্তি প্রদান করতে পারেন। 
১.১২. নারী ও শিশু পাচার কোন ধরনের শাস্তিযোগ্য অপরাধ?
ইসলামী শরীআতে দৃষ্টিতে অপরাধ যাই হোক না কেন তা উল্লেখিত তিন প্রকারের শাস্তি পদ্ধতির মধ্যে সীমাবদ্ধ। অপরাধটির শাস্তি হবে সহায়তা হদ সংক্রান্ত, কিংবা কিসাস বা দিয়াত সংক্রান্ত, নয় তো তা’যীর সংক্রান্ত হবে।
নারী ও শিশু পাচারের শাস্তি উল্লেখিত তিন প্রকারের ইসলামী শাস্তি পদ্ধতিতর কোন প্রকারের অন্তর্র্ভূক্ত 
পাচার কিসাস এর শাস্তি আরোপ করার মত অপরাধ নয়, আবার হুদুদ সংক্রান্ত যতটি অপরাধের উল্লেখ করা হয়েছে তারও আওতাভুক্ত নয়। এটি অধিকাংশ ক্ষেত্রে একটি প্রতারণামূলক কাজ। প্রতারণার মাধ্যমে পাচারকারীরা মানুষকে ক্ষতিকর ও সমাজবিরোধী কাজের সাথে সম্পৃক্ত করছে। তাই এটি তা’যীর সংক্রান্ত অপরাধ সমূহের একটি অপরাধ। 
অতএব প্রতারণার মাধ্যমে পাচারের শাস্তি বিধানে সরকার তার ধরন ও ভয়াবহতার ভিত্তিতে মৃত্যুদ-, চাবুক মারা, জেলে আটকে রাখা, নির্বসনে দেয়া, মাল ক্রোক করা, শোকজ নোটিশ, সতর্কীকরণ নোটিশ, সশরীরে আদালতে হাজির হওয়ার নির্দেশ, বয়কট করা, ভর্ৎসনা করা ও উপদেশ দেওয়া ইত্যাদির যে কোন শাস্তি নির্ধারণ করতে পারে। ইসলামী আইনে তাতে কোন বিধি-নিষেধ আরোপ করেনি। 
তবে যদি পাচারকারী কোন নারীকে ভয়-ভীতি দেখিয়ে অথবা অপহরণ করে পাচার করে, তবে তার উপর অপহরণের জন্য শারী’অত শাস্তি ( হাদ্দুল হিরাবা) প্রযোজ্য হবে। আর যদি কেউ শিশুকে চুরি করে পাচার করে তবে তাকে তা’যীর হিসাবে রাষ্ট্র্র যে কোন ধরনের শাস্তি দিতে পারে। তবে মানুষ চুরির দায়ে চুরির জন্য নির্ধারিত শাস্তি (হদ) দেয়া যাবে কিনা বিষয়টি মতভেদপূর্ণ। অবশ্য একদল ‘আলিম মনে করেন যে, মানুষ চুরির দায়ে হাত কাটার শাস্তি প্রযোজ্য হবে না। 
২.১৩. নারী ও শিশু পাচার রোধে প্রচলিত আইন
নারী ও শিশু নির্যাতন রোধে বালাদেশে সর্বপ্রথম নারী ও শিশু নির্যাতন দমন আইন ২০০০ প্রণীত হয়। অত:পর ২০০৩ সনে তা সংশোধন করে ‘‘নারী ও শিশু নির্যাতন দমন সংশোধনী আইন ২০০৩’’ নামে একটি আইন পাশ হয়। উক্ত আইনে নারী ও শিশু পাচারের মত জঘন্য অপরাধের সাথে জড়িত ব্যক্তিদের জন্য কঠোর বিধান রেখে বলা হয়, ‘‘পাচারকারীর সর্বোচ্চ শাস্তি মৃত্যুদ- বা যাবজ্জীবন কারাদ- বা অনধিক ২০ বছর তবে ১০ বছরের কম নয় সশ্রম কারাদ- এবং অর্থদ- হতে পারে।” 
এ আইনের যথার্থ প্রয়োগ করতে পারলে বাংলাদেশ থেকে নারী ও শিশু পাচার রোধ করা সম্ভব।
২.১৪. প্রচলিত আইন কি ইসলামী আইনের সাথে অসংগতিপুর্ণ?
আমাদের দেশে ফৌজদারী দ- বিধি বেশকিছু ধারা শারী’আহ আইনের সাথে তেমন কোন বৈপরীতা নেই। নারী ও শিশু পাচার সংক্রান্ত শাস্তি তার অন্যতম। কারণ ইসলাম তা’যীর সংক্রান্ত সকল আইন প্রণয়নেে ক্ষমতা সরকারকে প্রদান করেছে। তবে সে আইনটি হতে হবে জনহিতকর, জনকল্যাণকর। কোনক্রমেই তা দমন বা নিপীড়ণমূূলক হতে পারবে না। 
অতএব সমাজের শৃংখলা বিধানের জন্য এবং নারী ও শিশু পাচারের মত জঘন্য অপরাধ দমনের জন্য বাংলাদেশের প্রচলিত আইনে সর্বোচ্চ মৃত্যুদ- যে শাস্তির বিধান রাখা হয়েছে তা ইসলামী দৃষ্টিভঙ্গির সাথে সংগতিপূর্ণ। ইসলামী আইনের সাতে এর কোন অসংগতি নেই। অবশ্য ভয়ভীতি, ছিনতাই ও অপহরণের মাধ্যমে কোন শিশু ও নারীকে পাচার করা হলে সেজন্য হিরাবা বা অপহরণকারীর জন্য নির্ধারিত শাস্তির বিধান রাখা উচিত। 
৩.০. পাচার রোধে ইসলামী মূল্যবোধ প্রচার ও প্রসারের গুরুত্ব
পাচার রোধে আইনের তঠোর প্রয়োগের পাশাপাশি ইসলামী মূল্যবোধের প্রচার ও প্রসার অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ ও কার্যকরী ভুমিকা পালন করতে পারে। এ লক্ষ্যে নি¤œবর্ণিত উদ্যোগ গ্রহণ করা যেতে পারে। যেমন-
৩.১. ইসলামী নৈতিকতায় জনগনকে উজ্জীবিত করা। 
টাকার লোভে একশ্রেণির অপরাধি নারী ও শিশু পাচারে লিপ্ত হয়। ধর্মীয় ব্যক্তিত্ব ও শিক্ষক সমাজ এ বলে জনগণকে উজ্জীবিত করতে পাারেন যে, পাচার একটি নৈতিকতা বিরোধী হারাম কাজ। সুতরাং এর মাধ্যমে উপার্জিত সকল অর্থও হারাম। হারাম উপার্জনকারী কোন আমলই আল্লাহর কাছে গ্রহণযোগ্য নয়। দীর্ঘ এক হাদীসে রাসূল সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়াসাল্লাম হারাম ভক্ষণকারী সম্পর্কে বলেন, ‘‘তার খাদ্য, পানীয় এবং পোশাক-আশাক সবই হারাম। কিভাবে তার দু’আ আল্লাহর নিকট কবুল হবে? 
রাসূর সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম আরো বলেন, ‘‘তোমরা ক্ষুধার্তকে খাদ্য দান কর, রোগীর সেবা এবং বিনা বিচারে আটক বন্দীদের মুক্তি কর।” রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম অন্যত্র বলেন, ‘‘তোমরা পৃথিবীতে অবস্থিত আল্লাহর সৃষ্টির জীবের প্রতি করুণাশীল হও তবে আসমানে অবস্থিত আল্লাহ তোমাদের প্রতি করুণাশীল হবেন।” তিনি আরো বলেন, ‘‘যে ব্যক্তি পৃথিবীতে কোন মু’মিনের বিপদ দূর করতে সহায়তা করে কিয়ামতে দিন আল্লাহ তার বিপদ-আপদ দূর করবেন।” 
এসব আয়াত ও হাদীস থেকে প্রমাণিত হয় যে, পাচারের মাধ্যমে নির্যাতিত নারী ও শিশুদের রক্ষায় আত্মনিয়োগ করা প্রতিটি মুসলমানের উপর অবশ্য করণীয়। 
ইসলামী নৈতিকতাবোধে উদ্ধুদ্ধ হলে কোন মানুষ পাচার কার্যে লিপ্ত হতে পারে না। মূলত: মানুষ যখন ধর্মীয় অনুশাসন অমান্য করে স্বেচ্ছাচারী জীবন যাপন করে, তখনই মানবতা দানবতায় পরিণত হয়। মানুষের ভ্রতৃত্ব, মাবনতাবোধ, সহমর্মিতা, সহানুভুতি ইত্যাদি লোপ পায়। পবিত্র কুর’আন এবং সুন্নাহ মানুষের মধ্যে নৈতিকতা, পারিবারিক বন্ধন, ভ্রাতৃত্ববোধ ও সহমর্মিতা প্রদর্শনের উদ্ধুদ্ধ করে থাকে। অতএব পবিত্র কুরআন-সুন্নাহ অধ্যয়ন ও অনুশীলনের মাধ্যমেই পাচারের মত অনৈতিক রোধ করা সম্ভব। 
৩.২. সামাজিক প্রতিরোধ গড়ে তোলা
ধর্মীয় নেতৃবৃন্দ ও শিক্ষকবৃন্দ পাচারের বিরুদ্ধে সামাজিক প্রতিরোধ গড়ে তুলতে পারেন। এ ধরনের প্রতিরোধ গড়ে তোলা প্রত্যেক মুসলমানের দায়িত্ব। অসহায় নারী, পুরুষ ও শিশুদের পাশে দাড়ানোর নির্দেশ দিয়ে মহান আল্লাহ বলেন, ‘‘তোমাদের কি হল যে, তোমরা আল্লাহর পতে সংগ্রাম করছো না? অথচ দুর্বল নারী, পুরুষ ও শিশুরা চিৎকার করে বলছে যে, হে আমাদের রব! আপনি আমাদের জালিমের জনপদ থেকে উদ্ধার করুন। আপনি আমাদের জন্য আপনার পক্ষ থেকে বন্ধু ও সাহায্যকারী পাঠান। 
৩.৩. জুমা’র খুৎবায় এবং শ্রেণিকক্ষে পাচারের বিরুদ্ধে কথা বলা
ইমাম, খতিব ও শিক্ষকদের যিনি যেখানে কথা বলার সুযোগ পাচ্ছেন সেখানেই অবস্থার প্রেক্ষিতে পাচারের মত অন্যায়ের বিরুদ্ধে কথা বলতে হবে। এ ব্যাপারে রাসূর সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেন, ‘‘সত্তার শপথ, যার হাতে আমার পাণ! অবশ্যই তোমরা মানুষকে সৎকাজের আদেশ করবে এবং অসৎ কাজের নিষেধ করবে। যদি তা না করো তবে অচিরেই আল্লাহ তোমাদের শাস্তি নিপতিত করবেন। তখন তোমরা দু’আ করবে কিন্তু তা কবুল হবে না।” 
৩.৪. সহযোগিতার হাত সম্প্রসারিত করা
ক. সমসংস্থনের ব্যবস্থা করা বা সন্ধান দেয়া। 
খ. ক্ষুদ্র্ঋণের ব্যবস্থা করা। 
গ. অসহায় মেয়েদের বিয়ের ব্যবস্থা করা। 
ঘ. বিধবা ও তালাক প্রাপ্তা মেয়েদের অবহেলা না করে আত্মনির্ভরশীল হথে সহায়তা করা। 
ঙ. ছিন্নমুল শিশুদের পড়া শুনা ব্যাপারে সহায়তা করা। 
৩.৫. পারস্পরিক যোগাযোগ বৃদ্ধি করা
এ পর্যায়ে ধর্মীয় নেতৃবৃন্দ যেসব কাজ করতে পারেন-
ক. ব্যক্তিগত পর্যায়ে পারস্পরিক মত বিনিময় করা। 
খ. অন্যান্য ধর্মের নেতৃবৃন্দের সাথে সম্যাটি নিয়ে আলাপ আলোচনা করা। 
গ. সেমিনার, সিম্পোজিয়াম-এর সাথে আয়োজন করা। 
ঘ. তথ্য ও উপাত্ত সংগ্রহ করা এবং সমস্যাটির উপর লেখালেখি করা। 
৪.০. উপসংহার 
পরিশেষে বালা যায় যে, নারী ও শিশু পাচার একটি গুরুত্ব অপরাধ। পৃথিবীর বহু দেশে এটি ব্যাপকভাবে বিস্তার লাভ করছে। এ সমস্যা থেকে উত্তরণ পেতে রাষ্ট্র, সরকার ও সমাজের সকল মানুষকে বিশেষ করে আলিম সম্প্রদায় শিক্ষক সমাজকে বলিষ্ঠ ভূমিকা পালন করতে হবে।

nibrasbd