শ্রমের মর্যাদা ও শ্রমিকের অধিকার : ইসলামী দৃষ্টিকোণ

শ্রমের মর্যাদা ও শ্রমিকের অধিকার : ইসলামী দৃষ্টিকোণ

ইসলাম মানুষের দুই জীবনের কথা বলে। দুনিয়ার জীবন ও আখিরাতের জীবন। কতইনা সুন্দরভাবে মহান আল্লাহ এই দুই জীবনের কল্যাণে কাজ করার জন্য বলেছেন। তিনি এই দুই জীবনের কল্যাণ ও উন্নতি কামনার জন্য দোআ করার তাগিদ দিয়েছেন।

আল্লাহ বলেন- 
فَمِنَ النَّاسِ مَنْ يَقُولُ رَبَّنَا آتِنَا فِي الدُّنْيَا وَمَا لَهُ فِي الْآخِرَةِ مِنْ خَلَاقٍ. وَمِنْهُمْ مَنْ يَقُولُ رَبَّنَا آتِنَا فِي الدُّنْيَا حَسَنَةً وَفِي الْآخِرَةِ حَسَنَةً وَقِنَا عَذَابَ النَّارِ . أُولَئِكَ لَهُمْ نَصِيبٌ مِمَّا كَسَبُوا وَاللَّهُ سَرِيعُ الْحِسَابِ.
‘একদল মানুষ যারা বলে, হে আমার রব আপনি আমাদের পার্থিব জীবনে কল্যাণ দিন। তাদের জন্যে আখিরাতে কোন হিস্যা নেই। আর তাদের (মানুষের) মধ্যে যারা বলে, হে আমার রব, আপনি আমাদের পার্থিব জীবনে কল্যাণ দিন আার আখিরাতের জীবনেও সফলতা দিন এবং আমাদের জাহান্নামের আগুনের শাস্তি থেকে রক্ষা করুন। এসব লোকদের জন্য তাদের অর্জন উপযোগী হিস্যা রয়েছে। আল্লাহ দ্রুত হিসাব গ্রহণকারী।” 
ইসলাম সব সময় কর্মের কথা বলে । নারী হোক কিংবা পূরুষ হোক তাকে প্রতিটি সময় কোনোনা কোনো কাজে ব্যয় করতে হবে। তবে সে কাজ হতে হলে কল্যাণের জন্য, মানুষের সুন্দর জীবন পরিচালনার জন্য, আল্লাহর হুকুম মানার জন্য। সূরা নাবা-তে আল্লাহ বলেন-
وَجَعَلْنَا اللَّيْلَ لِبَاسًا. وَجَعَلْنَا النَّهَارَ مَعَاشًا.
“আমি রাতকে বিশ্রামের জন্য এবং দিনকে কর্মের জন্য বা কর্মের মাধ্যমে উপার্জনের জন্য বানিয়েছি।” 
সূরা জুমুআতে আল্লাহ বলেন-
فَإِذَا قُضِيَتِ الصَّلَاةُ فَانْتَشِرُوا فِي الْأَرْضِ وَابْتَغُوا مِنْ فَضْلِ اللَّهِ.
“যখন জুমুআর নামায শেষ হবে তখন তোমরা পৃথিবিতে কাজ ছড়িয়ে পড়ো এবং মহান আল্লাহ নেয়ামত বা সম্পদ অর্জন করো।” 
সূরা বুরূজে আল্লাহ বলেন-
إِنَّ الَّذِينَ آمَنُوا وَعَمِلُوا الصَّالِحَاتِ لَهُمْ جَنَّاتٌ تَجْرِي مِنْ تَحْتِهَا الْأَنْهَارُ ذَلِكَ الْفَوْزُ الْكَبِيرُ.
“নিশ্চয় যারা ঈমান এনেছে এবং সৎকর্ম সম্পাদন করেছে তাদের জন্য রয়েছে এমন জান্নাত যার তলদেশে ঝর্ণাধারা প্রবাহিত। সেটি হচ্ছে বিশাল সফলতা।” 
সূরা আল মুলকে আল্লাহ বলেন-
الَّذِي خَلَقَ الْمَوْتَ وَالْحَيَاةَ لِيَبْلُوَكُمْ أَيُّكُمْ أَحْسَنُ عَمَلًا.
“তিনি হলেন আল্লাহ যিনি তোমাদের জন্য জীবন ও মৃত্যু দান করেছেন, যাতে তিনি এ পরীক্ষা করে নিতে পারেন যে, কে ভালো কাজ করে।” এ আয়াতেও আল্লাহ তাআলা কাজের কথা বলেছেন। কাজ করার মাধ্যমেই কল্যাণ আর না করার মাধ্যমেই অকল্যাণের সাথী হতে হবে বলে আল্লাহ বিভিন্ন জায়গায় বর্ণনা করেছেন। 
আমাদের প্রিয় নবী গোটা জীবন শুধু কাজই করেছেন। নবুয়্যতের আগে ও পরে বিভিন্ন সময় ছাগল চড়িয়েছেন, ব্যবসায় পরিচালনা করেছেন, সংসার করেছেন, বিচার আচার করেছেন, দেশ চালিয়েছেন, বিবাধ মিটিয়েছেন যুদ্ধ করেছেন আবার রাতভর ইবাদত করেছন আর দিনভর রোযা রেখেছেন। এসব কি কাজ নয়? নিশ্চয়ই কাজ এবং কাজ। 
হযরত দাউদ আলাইহিস সালাম নিজের হাতে কাজ করেছেন। 
ما أكل أحد طعاماً خير من أن يأكل من عمل يده، وإن نبي الله داود كان يأكل من عمل يده -عليه الصلاة والسلام-
“নিজের হাতে কাজ করে জীবিকা অর্জন করে খাদ্য গ্রহণের চেয়ে উত্তম কোনো খাবার হতে পারে না। হযরত দাউদ আলাইহিস সালাম নিজের হাতে কাজ করে খেতেন।” 
একটি প্রশিদ্ধ হাদিস সম্পর্কে আমরা প্রত্যেকেই জানি যে, একদা এক ব্যক্তি রাসূল (সা) এর কাছে ভিক্ষার জন্য এলে তিনি তাকে কম্বল বিক্রি করে একটি কুঠার কিনে তার মাধ্যমে কাজ করে কাঠ সংগ্রহ করে তা বিক্রি করে জীবিকা নির্বাহ করতে বললেন এবং ভিক্ষা পরিহার করতে বললেন। 
উল্লেখিত সকল প্রমাণাদি থেকে বুঝা যায় যে, ইসলাম সব সময় কাজ করার পক্ষে। শ্রমের পক্ষে তার অবস্থান। সে নারী হোক আর পুরুষ হোক। ইসলামে অলসতার কোন স্থান নেই। 
সাধারণত যারা অর্থের বিনিময়ে অন্যের কাজ করে দেন তাদের শ্রমিক বলে। নিজের কাজ নিজে করলে তাকে সাধারণত শ্রমিক বলে না। যারা শ্রমিক হিসেবে কাজ করে যুগে যুগে তাদের প্রতি বিভিন্নভাবে অবিচার করা হয়েছে। তাদের শারীরিক ও মানসিক নির্যাতনের পরিসংখ্যান অনেক বড়। তাদের অমর্যাদা ও সাধ্যের বাইরে কষ্ট দেয়ার ইতিহাস অনেক পুরোনো। তাদের মানুষ হিসেবে যে অধিকার পাবার কথা ছিলো যুগে যুগে তা না পাওয়ায় অনেক আন্দোলন হয়েছে, হয়েছে অনেক বিধি -বিধান, আইন-কানুন। অনেক সময় তা কাগজে কলমে পাওয়া গেলেও বাস্তবে পাওয়া বড়ো ঢের। বর্তমানে শ্রমিকদের অধিকার ও মর্যাদার বিষয়ে অনেক বক্তব্য আমরা হর হামেশা শুনে থাকি। বিশেষ করে পহেলা মে আসলেতো কোনো কাথাই নেই। শ্রমিক দিবসের আলোচনা, বক্তৃতা বিবৃতি সর্বত্র। কিন্তু ইসলাম শ্রমিকের মর্যাদা ও সম্মান রক্ষায়, তাদের অধিকার প্রতিষ্ঠায় সব সময়ই ছিলো সোচ্চার ও তৎপর। 
নি¤েœ শ্রমিকের মর্যদা ও অধিকার প্রতিষ্ঠায় ইসলামের ভাষ্য কি তা কিছুটা আলোকপাত করা হলো।
১. যথাযথ পারিশ্রমিক পাবার অধিকার : শ্রমের সাথে পারিশ্রকের সম্পর্ক অত্যন্ত নিবিড়। আলকুরআনুল কারীমে আল্লাহ তাআলা ১৫০ জায়গায় শ্রম/আমল এবং তার পারিশ্রমিক বা আজর এর কথা উল্লেখ করেছেন। 
আল্লাহ বলেন-
إلا الذين آمنوا وعملوا الصالحات فلهم أجر غير ممنون
“নিশ্চয়ই যারা ইমান গ্রহণ করলো এবং সৎকর্ম সম্পাদন করলো তাদের জন্য রয়েছে অফুরান্ত পুরস্কার(পারিশ্রমিক/ফল)।” 
এ আয়াতসহ অন্যান্য আয়াতে যদিও আখিরাতে দিনী কাজের জন্য আল্লাহ পুরস্কারের কথা উল্লেখ করেছেন। তবে তা শুধু আখিরাতের সাথেই সম্পৃক্ত নয়। দুনিয়ার কাজের ব্যপারেও যেখানেই শ্রম থাকবে সেখানেই পাশ্রিমিক থাকতে হবে।
“আল্লামা ইবনে হাযম বলেন, 
فجميع الآيات التى ذكر فيها العمل والأجر ليست خاصة بالأعمال ذات الطابع الدينى ، وإنما هو قانون عام شامل لكل نوع من أنواع العمل سواء كان عملاً دينياً أو عملاً دنيوياً
“ যেসব আয়াতে আমল ও পুরস্কারের আলোচনা হয়েছে তার প্রত্যেকটি কেবল দিনী আমলের সাথেই সম্পৃক্ত নয় বরং এটি হলো সাধারণ একটি বিধান, যার আওতায় দুনিয়া ও দীনী সকল প্রকারের আমাল অন্তর্ভূক্ত।” 
একজন শ্রমিক অন্যেক কাজ করে অর্থের প্রয়োজনে। তিনি তার শ্রম দিচ্ছেন নিজের জীবন পরিচালনা এবং তার পোষ্যদের ভরণ-পোষণ নির্বাহ করার জন্যে। তাই তাকে যথাযথ পারিশ্রমিক দেয়া যিনি শ্রমিক হিসেবে নিয়োগ করবেন তার নৈতিক দায়িত্ব। 
যদি নিয়োগকারী কর্তৃপক্ষ যথাযথ/আলোচনার ভিত্তিতে নির্ধারিত পারিশ্রমিক প্রদান না করে, তার প্রাপ্য পারিশ্রমিক কমিয়ে দেয় কিংবা ঠকিয়ে দেয় তিনি হবেন আল্লাহর দৃষ্টিতে জালিম। আর জালিমের জন্য রয়েছে কঠিন শাস্তি। তার কোন সাহায্যকারী কিয়ামতে থাকবে না। আল্লাহ বলেন-
ما للظالمين من حميم ولا شفيع يطاع “
“জালিমের জন্য কিয়ামতের দিন কোনো বন্ধু ও সুপারিশকারী থাকবে না।” আল্লাহ আরো বলেন-
” وما للظالمين من نصير.
জালিমের জন্য (কিয়ামতের দিন) কোনো সাহায্যকারী থাকবে না।” 
রাসূল (সা) বলেন-
يَا عِبَادِى إِنِّى حَرَّمْتُ الظُّلْمَ عَلَى نَفْسِى وَجَعَلْتُهُ بَيْنَكُمْ مُحَرَّمًا فَلاَ تَظَالَمُوا 
“ ওহে আমার বান্দা! আমি আমার জন্যে কাউকে জুলুম করা নিষিদ্ধ করে দিয়েছে। আর এ জুলুমকে আমি তোমাদের পরস্পরের উপর করা হারাম ঘোষণা করেছি। সুতরাং তোমরা জুলুম করো না।” 
اِتَّقُوا الظُّلْمَ فَإِنَّ الظُّلْمَ ظُلُمَاتٌ يَوْمَ الْقِيَامَةِ.
“ তোমরা জুলুমকে ভয় করো। কেননা, জুলুম কিয়ামতের দিন অন্ধকার জীবনের কারণ হবে।” 
যথাযথ পারিশ্রমিক বলতে কী বুঝায় তার কিছুটা ব্যাখ্যা এখানে পেশ করা যেতে পারে। সংক্ষেপে বলা যায় যে, যথাযথ পারিশ্রমিক নির্ভর করবে স্থান কাল পাত্র ভেদে। এ ক্ষেত্রে পদ পদবির আলোকে এবং দেশের প্রচলন একটি গুরুত্বপূর্ণ দিক। ইসলামী আইনে প্রচলনের বিশাল গুরুত্ব রয়েছে। এজন্যে আইনের একটি মূলনীতি হচ্ছে – العادة محكمة 
শধু ইসলামই নয় আন্তর্জাতিক আইনেও ঈঁংঃড়সধৎু খধি অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। 
দ্বিতীয়ত : আলোচনা সাপেক্ষে যদি কোনো শ্রমিকের বেতন-ভাতা বা পাশ্রিমিক নির্ধারিত হয় তাও যথাযথ বলেই মনে করতে হবে। এ ব্যাপারেই ইসলামী আইনের মূলনীতি হলো-

الصلح جائز بين المسلمين إلا صلحا أحل حراما أو حرم حلالا. 
ইসলামে যদি হালাকে হারাম কিংবা হারামকে হালাল করা নয় হবে মুসলিমদের মধ্যে পরস্পর চুক্তি করা জায়েয। 
অবশ্য দেশের শ্রম মন্ত্রণালয় যদি দেশের আর্থ সামাজিক অবস্থা, জীবনযাত্রার মান ইত্যাদি বিবেচনা করে বাস্তবসম্মত সর্বনি¤œ কোন পারিশ্রমিক নির্ধারন করে দেয় তবে তাকেও যথাযথ পারিশ্রমিক বলা যেতে পারে। তা পাওয়া শ্রমিকের অধিকার। 
২. কাজ শেষে বিলম্ব ব্যতিরেকে পারিশ্রমিক পাবার অধিকার : শ্রমিককে তার মজুরী দিতে হবে পরিশ্রম শেষে অনতিবিলম্বে। অর্থাৎ শর্তানুযায়ী নির্দিষ্ট সময়ে পারিশ্রমিক পরিশোধ করতে হবে। কোনভাবেই তাকে হয়রানী করা যাবে না কিংবা ধোকা দেয়া যাবে না। ইসলামের বক্তব্য হলো- 
শর্তানুযায়ী এবং ওয়াদা অনুযায়ী পারিশ্রমিক পরিশোধ না করলে তা মুনাফেকী। আর মুনাফেকী করা হরাম। রাসূল (সা) বলেন-
“آيَةُ الْمُنَافِقِ ثَلاَثٌ: إِذَا حَدّثَ كَذَبَ. وَإِذَا وَعَدَ أَخْلَفَ. وَإِذَا ائْتُمِنَ خَانَ”.
“মুনাফিকের নিদর্শন তিনটি। যখন সে কথা বলে মিথ্যা বলে, যখন সে ওয়াদা করে ভঙ্গ করে আর যখন তার কাছে কোনো জিনিস আমানত রাখা হয় তখন সে তাতে খেয়ানত করে। ” 
৩. সাধ্যের বাইরে কাজ না করার অধিকার : শ্রমিকের একটি অধিকার হলো তাকে মািিলক পক্ষের থেকে এমন কাজ দেয়া যাবে না যা তার সাধ্য ও সামর্থ্যের বাইরে। যদি মালিকপক্ষ এমন কাজ দেয় যা তার শর্তের আওতায় নয় কিংবা শারিরীক ও মানসিকভাবে মেনে নেয়ার মতো নয় কিংবা যে কাজটি চাপিয়ে দিলে ভবিষ্যতে তার শারীরিক ও মানসিক ক্ষতি হবার সম্ভাবনা আছে তবে শ্রমিকে সে কাজটি না করে প্রত্যাখ্যান করার অধিকার রয়েছে। হযরত মুসা (আ) যখন হয়রত শুআইব (আ) কে শ্রমিক হিসেবে নিয়োগ দিলেন তখন বললেন-
وما أريد أن أشق عليك “
“আমি তোমার উপর কঠিন কোনো কিছু চাপিয়ে দিতে চাই না।” ইসলামের একটি মূলনীতিই হলো সাধ্যের বাইরে কোনো কিছু চাপিয়ে না দেয়া। আল্লাহ তাআলা সে কখা এভাবে বলেন- 
لا يُكَلِّفُ اللَّهُ نَفْساً إِلَّا وُسْعَهَا
“আল্লাহ কোনো ব্যক্তিকে/নফসকে তার সাধ্যেও বাইরে কোনো কিছু চাপিয়ে দেন না।” 
৪. শক্তি কমে গেলেও শ্রমিককে কাজ অব্যাহত রাখার অধিকার : কোনো শ্রমিককে মালিকপক্ষ যদি যুবক থাকা অবস্থায় নিয়োগ দান করেন আর জীবনের কোনো এক পর্যায়ে বাধ্যক্যের কারণে কিংবা অসুস্থতার কারণে কাজে কিছুটা অক্ষমও হয়ে পড়ে তবে সে শ্রমিককে বিদায় দেয়ার অধিকার মালিকের নেই। শ্রমিকের সে অবস্থায়ও কাজে অব্যাহত থাকার অধিকার রয়েছে। তবে আলাপ- আলোচনার মাধ্যমে কোনো সুযোগ সুবিধা গ্রহণ করে কর্ম থেকে বিদায় নিতে বা দিতে কোনো অসুবিধা নেই। 
এ ব্যাপারে রাসূল (সা) এর জীবকালের একটি ঘটনা প্রনিধানযোগ্য। রাসুলের যামানায় এক ব্যক্তি তার একটি উটকে যুবক থাকতে কঠিন কঠিন বোঝা চাপিয়ে দিতো। এক পর্যায়ে উটটি বৃদ্ধ হয়ে গেলে সে উটটিকে ভরণপোষণের দায় থেকে বাঁচার জন্য জবেহ করার ইচ্ছে পোষণ করলে রাসূল (সা) তাকে বললেন- 
” أكلت شبابه حتى إذا عجز أردت أن تنحره “
“তুমি ওর যেীবনকাল খেয়ে ফেলেছো আর যখন বৃদ্ধ হয়েছে তখন তুমি তাকে জবেহ করতে ইচ্ছে করেছো।” 
তখন ঐ ব্যক্তি উটটিকে ছেড়ে দিলো। 
৫. যথাযথ সম্মান পাবার অধিকার : ইসলামের দৃষ্টিতে প্রত্যেকটি মানুষ সম্মানিত। অপরাধী প্রমাণিত না হওয়া পর্যন্ত প্রত্যেকেই মানুষ হিসেবে সম্মান পাবার অধিকার সংরক্ষণ করে। সে ধনী হোক কি গরীব হোক, শ্রমিক হোক কি মালিক হোক। শ্রমিকরা সাধারণ শ্রেণির হলে অনেক ক্ষেত্রে দেখা যায় যে, তাকে মালিকপক্ষ তুচ্ছ তাচ্ছিল্ল করেন, তাকে অপছন্দনীয় উপনামে ডাকাডাকি করেন, অযথা কষ্ট দেন মাঝে মধ্যে তার সাথে এমন আচরণ করেন যেন মনে হয় সে কোনো মানুষই নয়। ইসলামের দৃষ্টিতে তা অবৈধ ও হারাম। শ্রমিক যত সাধারণই হোক না কেন তাকে সাধারণ সম্মান ও মর্যাদা দিতে হবে। আল্লাহ তাআলা মানুয়ের মর্যাদা রক্ষায় বলেন-
وَلَقَدْ كَرَّمْنَا بَنِي آدَمَ
“নিশ্চয়ই আমি আদম সন্তানকে সম্মানিত করেছি।” 
রাসূল (সা) বলেন-
المسلم على المسلم حرام عرضه وماله ودمه
“একজন মুসলমানের জন্য অন্যে মুসলমানের জীবন, সম্পদ ও সম্মানের হানি করা হারাম—।” 
আল্লাহর রাসূল শ্রমিকেরে মর্যাদা প্রদানের নিমিত্ত শ্রমিকের সাথে বসে খেতেন। তিনি শ্রমিককে সেসব খাবার খাওয়াতে বলেছেন যা মালিক খাবেন, সেসব পোষাক-পরিচ্ছদ পড়াতে বলেছেন যা মালিক পরিধান করবে। রাসূল (সা) এর ভাষায়-
إخوانكم خولكم جعلهم الله تحت أيديكم، فمن كان أخوه تحت يده فليطعمه مما يأكل وليلبسه مما يلبس ولا تكلفوهم ما لا يطيقون، فان كلفتموهم فأعينوهم 
এর মানে হলো শ্রকিককে অন্য বস্ত্র ও বাস্স্থানের ক্ষেত্রে যথাযথ সম্মান দিতে হবে। তাকে অমর্যাদাকর খাবার কিংবা বস্ত্র পড়ানোর ব্যবস্থা করা যাবে না। 
৬. ধর্ম কর্ম পালন করার অধিকার : শ্রমিক স্বীয় ধর্ম পালন করার অধিকার সংরক্ষণ করবেন। তাকে মৌলিক ধর্ম কর্ম করার জন্য প্রয়োজনীয় সময় দিতে হবে। বাধা দেয়া যাবে না। যদি ধর্মীয় কাজ করতে দেয়া না হয় কিংবা বাধা দেয়া হয় তবে আল্লাহর ভাষায় সে চরম ভ্রষ্টতার মধ্যে নিমজ্জিত থাকবে। আল্লাহ বলেন-
الذين يستحبون الحياة الدنيا على الآخرة ويصدون عن سبيل الله ويبغونها عوجاً ، أولئك في ضلال بعيد
“যারা পার্থিব জীবনকে ভালোবাসে এবং আল্লাহর পথে প্রতিবন্ধক হয়ে দাঁড়ায় ও তাতে বক্রতা সৃষ্টি করে তারা চরম ভ্রষ্টতার মধ্যে নিপতিত।” 
মুসলমান শ্রমিক হলে তাকে ফরয নামায, ফরয রোযা পালন করার জন্য সুযোগ দিতে হবে। কোনো মালিক যদি শ্রমিককে ফরয পালনের সুযোগ না দেন তবে ইসলামের দৃষ্টিতে সে শ্রমিক মালিকের বিরুদ্ধে কোর্টে করতে পারবে। কারণ, ধর্ম পালন করার অধিকার মানুষের মৌলিক অধিকারের অন্তভর্’ক্ত একটি অধিকার। 
৭. প্রতিকার চাওয়ার অধিকার : কোনো শ্রমিক যদি যথাযথ অধিকার ও প্রাপ্য থেকে বঞ্চিত হন তবে তার প্রতিকারের অধিকার রয়েছে। তিনি সেজন্য ন্যায় ইনসাফের ভিত্তিতে প্রতিকার চাইতে পারবেন। কোর্টে মামলা দায়ের করতে পারবেন। 
শ্রমিকের ব্যাপারে ইসলাম অত্যন্ত গুরুত্বারোপ করেছে। তাকে অসম্মানের স্থান থেকে সম্মানের আসনে আসীন করেছে। তার জীবনের নিরাপত্তা, পারিশ্রমিকের নিরাপত্তা, সামাজিক ও রাষ্ট্রীয় নিরাপত্তা নিশ্চিত করেছে। কিন্তু দুর্ভাগ্য হলো, আমাদের সমাজের মুসলিমগণও এসব দায়িত্বের ব্যাপারে জেনে না জেনে অবচেতন রয়েছে। সকল মুসলিমকে এ ব্যাপারে আরো সচেতন হওয়া দরকার বলে মনে করি। 
মালিকের দায়িত্বপালনে শ্রমিকের কর্তব্য : 
ইতঃপূর্বে শ্রমিকের অধিকার সম্পর্কে আলোচনা করা হয়েছে। এ পর্যায়ে আমি শ্রমিকের যেসব দায়িত্ব কর্তব্য রয়েছে তার কতিপয় দিক তুলে ধরতে চাই।
১. যথাযথভাবে দায়িত্ব পালন করা : মালিকের প্রতি একজন শ্রমিকের দায়িত্ব হলো, তিনি যে কাজের জন্য তাকে নিয়োগ দিয়েছেন সে দায়িত্ব যথাযথভাবে সাধ্যমত পালন করা। দায়িত্ব পালনে কোনো গাফলতি না করা। এ ব্যাপারে রাসূল (সা) বলেন-
ألا كُلُّكُمْ راعٍ ، وكُلُّكُمْ مَسؤولٌ عن رَعِيَّتِهِ
“ তোমরা প্রত্যেকে দায়িত্বশীল আর তোমাদের প্রত্যেককে সে দায়িত্ব সম্পর্কে জবাব দিতে হবে।” 
২. আমানতদারীর সাথে দায়িত্ব পালন করা এবং খেয়ানত না করা : শ্রমিকের দায়িত্ব হলো মালিক কর্তৃক অর্পিত দাযিত্ব আমানতের সাথে পালন করা। তাতে কোনোভাবে খেয়ানত না করা। ইসলামের দৃষ্টিতে প্রতিটি দায়িত্ব আমানতদারীর সাথে পালন করা ফরয। খেয়ানত করা হারাম। রাসূল (সা) বলেন-
“آيَةُ الْمُنَافِقِ ثَلاَثٌ: إِذَا حَدّثَ كَذَبَ. وَإِذَا وَعَدَ أَخْلَفَ. وَإِذَا ائْتُمِنَ خَانَ”.
“মুনাফিকের নিদর্শন তিনটি। যখন সে কথা বলে মিথ্যা বলে, যখন সে ওয়াদা করে ভঙ্গ করে আর যখন তার কাছে কোনো জিনিস আমানত রাখা হয় তখন সে তাতে খেয়ানত করে। ” 
তিনি আরেকটি হাদিসে বলেন- 
لَا إِيمَانَ لِمَنْ لَا أَمَانَةَ لَهُ وَلَا دِينَ لِمَنْ لَا عَهْدَ لَهُ
“যার আমানতদারী নেই তার ঈমান নেই আর যার ওয়াদাপালন নেই তার দীন নেই।” 
৩. মালিকের সম্পদ চুরি করা যাবে না : ইসলামে চুরি করা হারাম। তা যদি হয় মালিকের পক্ষ ঠিকঠাক মত পরিশ্রমিক পরিশোধের পর তবে তা আরো বেশী গুণাহর কাজ। রাসূল (সা) বলেন-
من استعملناه على عمل، فرزقناه رزقاً، فما أخذ بعد ذلك فهو غلول.
“যাকে আমরা কোনো দায়িত্ব প্রদান করেছি(কর্মচারী নিয়োগ করেছি) আর তাকে যথাযথ পারিশ্রমিক দিয়েছি তখন সে তার প্রাপ্য অধিকারের বাইরে গ্রহণ করবে তা হবে চুরি পর্যায়ের।” 
৪. মালিকের সাথে কোনোরূপ প্রতারণার আশ্রয় গ্রহণ না করা শ্রমিকের একটি গুরুতাবপূর্ণ দায়িত্ব। ইসলামে প্রতারনা করা হারাম। রাসূল(সা) বলেন-
مَنْ غَشَّنَا فَلَيْسَ مِنَّا
“ যে ব্যক্তি প্রতারণা করে সে আমার উম্মতের অন্তর্ভূক্ত নয়।” 
ইসলাম একটি সুন্দর সমাজ প্রতিষ্ঠায় সর্বদা দিক নিদের্শনা দিয়েছে। এজন্যে একদিকে শ্রমিকের ব্যাপওে মালিকের দায়িত্ব ও কর্তব্য বাতলে দিয়েছে তেমনি বাতলে দিয়েছে শ্রমিকের দায়িত্ব ও কর্তব্য। প্রত্যেকে যদি তাদের দায়িত্ব যথাযথভাবে পালন করে তবে সে সমাজ অত্যন্ত সুখের ও সমৃদ্ধিও সমাজ হওয়া সম্ভব। আসুন আমরা সবাই জীবনের প্রতিটি ক্ষেত্রে ইসলামের অনুশাসন মেনে চলি এবং সমাজের বিভিন্ন শ্রেণি ও পেশার মানুষকে মেনে চলতে উৎসাহিত করি।

ড. মোঃ নূরুল্লাহ
সেক্রেটারী জেনারেল, নিফাবা

nibrasbd