আল-কুরআনে ওয়াসিলা : একটি তাত্ত্বিক বিশ্লেষণ

আল-কুরআনে ওয়াসিলা : একটি তাত্ত্বিক বিশ্লেষণ

ইসলাম একটি পূর্ণাঙ্গ আদর্শের নাম। এ আদর্শের দুটো দিক রয়েছে। একটি হচ্ছে বিশ্বাস বা আকীদাগত দিক আর অন্যটি হচ্ছে আমল বা প্রয়োগগত দিক। প্রতিটি মানুষ তার মনের যে ধ্যান ধারণা পোষণ করে, যে আকীদা বিশ্বাস লালন করে বাস্তব বা আমলের ক্ষেত্রে তারই প্রতিফলন ঘটে।

উদাহরণস্বরূপ বলা যায়- কোন এক ব্যক্তির ধারণা হচ্ছে- আল্লাহর ওলীরা মৃত্যুবরণ করলেও তাঁদের অনেক ক্ষমতা থাকে। তাঁরা মানুষের জন্য আল্লাহর কাছে সুপারিশ করতে পারে। তাঁদের ওয়াসিলায় দুআ কবুল হয়। ঐ ব্যক্তির এ বিশ্বাস থাকার ফলে সে অলীদের মাজারে গিয়ে ধর্ণা দেয় এবং অলীর কাছে বিভিন্ন বিষয় চেয়ে দু‘আ করে, সম্পদ কামনা করে, সন্তান লাভের আশা করে ইত্যাদি। আমরা জানি যে, মানুষের মনে প্রথমে আকীদা বা বিশ্বাসের জন্ম হয় তারপর আমল বা কাজে এর প্রতিফলন ঘটে। এ কারণে ইসলামী শরীআতে আকীদা বিশুদ্ধ করার গুরুত্ব আমলের চেয়ে অনেক বেশি। তাই ইতিহাস সাক্ষ্য দেয় যে, মুহাম্মদ (সা) সর্বপ্রথম মানুষকে আকীদা বা বিশ্বাসকে বিশুদ্ধ করার আহবান জানিয়েছিলেন। তিনি প্রথমেই সালাত, সাওম কিংবা যাকাতের নির্দেশ দেননি।
আমাদের সমাজে ‘ওয়াসিলা’ গ্রহণ করার প্রচলন খুব ব্যাপকভাবে শোনা যায়। এটাকে ব্যাপকভাবে প্রচার করতেও দেখা যায় অনেককে। আল-কুরআনেও আল্লাহ তাআলা ওয়াসিলা গ্রহণ করতে বলেছেন। কিন্তু কেউ কেউ ওয়াসিলার এমন অপব্যাখ্যা করে আসছেন, যা মানুষকে শিরকের পর্যায়ভুক্ত করে দেয়। অবস্থা এমন পর্যায়ে এসে দাঁড়িয়েছে যে, পরগাছা বেশি হলে যেমন উপকারী গাছটি ঢাকা পড়ে যায় তেমনি ওয়াসিলার অপব্যাখ্যা প্রচার ও প্রসারের ফলে এ ব্যাপারে শরীআতের সঠিক দৃষ্টিভঙ্গি আজ অনেকটা ঢাকা পড়ে গিয়েছে। তাই প্রয়োজন আগাছাগুলোকে উপড়ে ফেলা। আল-কুরআনের সঠিক দৃষ্টিভঙ্গি মানুষের জন্য পেশ করা। সে লক্ষ্যেই আমার এ উপস্থাপনা।
শাব্দিক অর্থে ওয়াসিলা
অভিধানে ‘ওয়াসিলা’ (وسيلة) শব্দটি নি¤œলিখিত ৪টি অর্থে ব্যবহৃত হয়েছে, যথাঃ
১. منزلة عند الملكকোন সরকার প্রধানের নিকট বা রাজা-বাদশাহর নিকট মর্যাদা সম্পন্ন অবস্থান হচ্ছে ওয়াসিলা।
২.الدرجة স্তর, মর্যাদাসম্পন্ন স্থান। এ দুটো অর্থই কাছাকাছি। হাদীস শরীফে এ অর্থে وسيلة (ওয়াসিলা) শব্দটির প্রয়োগ দেখা যায়। রাসূলুল্লাহ (সা) ইরশাদ করেছেন-
ثم سلوا لي الوسيلة, فإنها منزلة في الجنة لا تنبغي إلا لعبد من عباد الله, وأرجو أن أكون أنا هو…….) الحديث
“…. তারপর তোমরা আল্লাহ তা‘আলার নিকট আমার জন্যে মর্যাদাসম্পন্ন অবস্থান চেয়ে দু‘আ কর। কারণ وسيلة (ওয়াসিলা) হচ্ছে জান্নাত অবস্থিত এমন এক সুমহান মর্যাদাসম্পন্ন স্থান বা আল্লাহর একজন বান্দা ব্যতীত অন্য কারো জন্য উপযুক্ত নয়। আশা করি যে, সে বান্দা হব আমি [মুহাম্মদ (সা)] ।
আযান পরবর্তী দুআর মধ্যেও রাসূলুল্লাহ (সা) وسيلة (ওয়াসিলা) শব্দ ব্যবহার করে সুমহান মর্যাদাকে বুঝিয়েছেন। সেখানে তিনি বলেন,
ات محمدا الوسيلة والفضيلة ….. الحديث
“তুমি (আল্লাহ) মুহাম্মদ (সা)-কে দার কর সর্বোচ্চ সম্মানিত স্থান ও সুমহান মর্যাদা।” 
৩.القربة বা নৈকট্য। যেমন বলা হয়, অমুক ব্যক্তি আল্লাহর ওয়াসিলা (নৈকট্য) লাভ করেছে। এ কথা তখণ বলা হয় যখন সে এমন কোন ভাল কাজ করে যার ফলে সে আল্লাহর নৈকট্য লাভ করে।”
৪.الوسطة বা ‘মাধ্যম’ যেমন বলা হয়, অমুক ব্যক্তির ওয়াসিরায় আমার কাজটা সমাধা হয়েছে অর্থাৎ তার মাধ্যমে। 
ওয়াসিলা গ্রহণ করার কাজটাকে আরবীতে বলা হয়التوسل 
শরীআতের দৃষ্টিতে ওয়াসিলা
ইসলামী শরীআতের দৃষ্টিতেتوسل বা ওয়াসিলা গ্রহণ করার অর্থ বর্ণনায় আল্লামা নাসীব আর রিফায়ী বলেন-
هو التقرب إلى الله تعالى بطاعته وعبادته واتباع أنبيائه ورسله وبكل عمل يحبه ويرضاه ـ 
“আল্লাহর বিধি-বিধানের অনুসরণ করা, তাঁর ইবাদত করা, তাঁর রাসূলের পথ নির্দেশ অনুযায়ী চলা এবং এমন সব কাজ করা যা তিনি পছন্দ করেন। এ সকল কাজের মাধ্যমে আল্লাহর নিকটবর্তী হবার নাম হচ্ছেتوسل বা ওয়াসিলা গ্রহণ। 
সহজ কথায় বলা যায়, ইসলামী শরীআতের নিকট গ্রহণযোগ্য- ভাল কাজ বা আমলে সালিহ করার মাধ্যমে আল্লাহর নৈকট্য লাভের প্রচেষ্টা করা হচ্ছে তাওয়াসুল বা ওয়াসিলা গ্রহণ।
সার্বিক বিচারে ওয়াসিলা তিন প্রকার। যথা-
১.الوسائل الكونية (আল ওয়াসাইলুল কাওনিয়্যাহ)
২.الوسائل الشرعية (আল ওয়াসাইলুশ শারইয়্যাহ)
৩.الوسائل البدعية (আল ওয়াসাইলুল বিদইয়্যাহ)
আল ওয়াসাইলুল কাওনিয়্যাহ
আল ওয়াসাইলুল কাওনিয়্যাহ মানে জাগতিক মাধ্যমসমূহ। অর্থাৎ মানুষের দৈনন্দিন জীবনের কোন কাজ সমাধা করতে গিয়ে প্রয়োজনে আল্লাহর কোন সৃষ্টি বা সৃষ্ট বস্তুকে মাধ্যম হিসেবে গ্রহণ করে কার্য সমাধা করা। যেমন- কোন ব্যক্তির খুব ক্ষুধা পেয়েছে। খাদ্য গ্রহণের মাধ্যমে তার ক্ষুধা নিবারণ করা হচ্ছে ওয়াসিলা কাওয়ানিয়্যাহ। এমনিভাবে কারো তৃষ্ণা পেলে পানির মাধ্যমে তৃষ্ণা নিবারণ করা ইত্যাদি।
আল কুরআনে ‘ওয়াসিলা’ ঃ একটি তাত্ত্বিক বিশ্লেষণ
এ ধরনের মাধ্যম গ্রহণ করা মুবাহ। মুসলিম-অমুসলিম নির্বিশেষে সকলের জন্যই এটা বৈধ। এক্ষেত্রে দুটো শর্ত অবশ্য পালনীয়Ñ
১. যে বস্তুকে মাধ্যম হিসেবে গ্রহণ করা হবে তা অবশ্যই মুবাহ বা বৈধ হওয়া চাই। তাই ক্ষুধা নিবারণের জন্য হারাম পশুর গোশত ভক্ষণ করলে সে ওয়াসিলা বৈধ নয়।
২. চাহিদার অপরিহার্যতা অর্থাৎ জাগতিক চাহিদা পূরণে এ সকল মাধ্যম গ্রহণ করা বৈধ হওয়ার দলীল হচ্ছে ঃ
১. মহান আল্লাহর বাণী ঃ
خَلَقَ لَكُمْ مَا فِي الْأَرْضِ جَمِيعًا
“তিনি (আল্লাহ) তোমাদের জন্য পৃথিবীর সকল বস্তুকে সৃষ্টি করেছেন।” 
২. তিনি অন্যত্র বলেন-
قُلْ مَنْ حَرَّمَ زِينَةَ اللَّهِ الَّتِي أَخْرَجَ لِعِبَادِهِ وَالطَّيِّبَاتِ مِنَ الرِّزْقِ
“বল! আল্লাহ যে সকল সৌন্দর্য এবং রিযক তাঁর বান্দাদের জন্য দান করেছেন তাকে কে হারাম করে দিল।?” 
আল ওয়াসাইলুশ শারইয়্যাহ
আল্লাহ তাআলা ও তাঁর নবীর নির্দেশিত নীতিমালার ভিত্তিতে মাকসুদ হাসিল করতে যে সকল মাধ্যম গ্রহণ করা যায় সেগুলো হচ্ছে “ওয়াসায়েলুশ শারইয়্যাহ ”।
সুতরাং কোন উদ্দেশ্যে পৌঁছতে আল্লাহ ও তাঁর রাসূলের নির্দেশিত পথ ও মতকে মাধ্যম হিসেবে গ্রহণ না করে অন্য কারো মত ও পথকে গ্রহণ করলে তা ওয়াসিলা শারইয়্যাহ নয়।
ওয়াসিলা শারইয়্যাহর পক্ষে নি¤œলিখিত উদাহরণগুলো পেশ করা যায়। যেমন- নিষ্ঠার সাথে কালেমা শাহাদাত উচ্চারণ করা জান্নাত লাভের একটি ওয়াসিলা বা মাধ্যম।
এমনিভাবে গুনাহের কাজ করার পরপরই কোন ভাল কাজ করা গুনাহ মাফের একটি মাধ্যম বা ওয়াসিলা। অনুরূপভাবে আত্মীয়তার সম্পর্ক সুন্দর ও সঠিক রাখা হায়াত ও রিযক বৃদ্ধির একটি ওয়াসিলা বা মাধ্যম। 
আল ওয়াসাইলুল বিদইয়্যাহ
কোন ব্যক্তি, বস্তু বা বিষয়কে আল্লাহর নিকটবর্তী মনে করে তার মাধ্যমে আল্লাহর নিকটবর্তী হওয়ার চেষ্টা করা যা কুরআন কিংবা হাদীসের দলীল দ্বারা সাব্যস্ত নয়। যাকে রাসূলুল্লাহ (সা) কিংবা সাহাবা কিরাম ওয়াসিলা হিসেবে গ্রহণ করেননি।
শরয়ী কিংবা বিদআত হবার মানদন্ড
দু‘আ করা একটি ইবাদত। এটা কোন ভাবে করলে শরয়ী হবে আর কোন ভাবে করলে বিদআত হবে তার মানদন্ড হচ্ছে আল কুরআন ও সুন্নাতে রাসূলুল্লাহ (সা) যা মহান আল্লাহ তাআলাই নির্ধারণ করে দিয়েছেন। আল্লাহ তাআলা বলেন-
فَإِنْ تَنَازَعْتُمْ فِي شَيْءٍ فَرُدُّوهُ إِلَى اللَّهِ وَالرَّسُولِ إِنْ كُنْتُمْ تُؤْمِنُونَ بِاللَّهِ وَالْيَوْمِ الْآخِرِ ذَٰلِكَ خَيْرٌ وَأَحْسَنُ تَأْوِيلًا (النساء : ৫৯)
“তোমরা যদি কোন ব্যাপারে মতপার্থক্য কর তবে আল্লাহ এবং তাঁর রাসূলে দিকে ফিরে যাও। যদি তোমরা আল্লাহ এবং আখিরাতের প্রতি ঈমান এনে থাক। এটাই হচ্ছে সবচেয়ে উত্তম সমাধান।” 
সুতরাং ওয়াসিলা গ্রহণের ক্ষেত্রে কোনটা শরীআত সম্মত হবে আর কোনটা বিদআত হবে তার সমাধান দেয় কুরআন ও সুন্নাহ। যে সকল ওয়াসিলা কুরআন ও সুন্নাহর দলীল অনুযায়ী হয় সেগুলো শরীআত সম্মত আর যেগুলোর পক্ষে কোন দলীল কুরআন ও সুন্নাহতে পাওয়া যায় না যেগুলো বিদআত।
আল কুরআনে ওয়াসিলা 
আল কুরআনুল কারীমের বেশ কয়েক আয়াতে (وسيلة) শব্দটি এসেছে। যার মধ্যে একটি আয়াতে বর্ণিত وسيلة শব্দটির ব্যাখ্যা নিয়ে দারুন বিভ্রান্তি সৃষ্টি হয়েছে।
আয়াতটি হলো ঃ
يَا أَيُّهَا الَّذِينَ آَمَنُوا اتَّقُوا اللَّهَ وَابْتَغُوا إِلَيْهِ الْوَسِيلَةَ وَجَاهِدُوا فِي سَبِيلِهِ لَعَلَّكُمْ تُفْلِحُونَ (المائدة : ৩৫)
“হে মু’মিনগণ! তোমরা আল্লাহকে ভয় কর আর তাঁর নিকটবর্তী হবার মাধ্যম অন্বেষণ কর এবং তাঁর পথে সংগ্রাম কর যাতে তোমরা সফলকাম হতে পার। 
এ আয়াতে وسيلة শব্দের ব্যাখ্যা কি তা আলোচনার পূর্বে আল কুরআনের কোন আয়াতের ব্যাখ্যার ক্ষেত্রে যে মূলনীতিগুলো অনুসরণ করা দরকার তা উল্লেখ করা উচিত। সেগুলো হচ্ছে ঃ
ক. কুরআনের কোন আয়াতের ব্যাখ্যা যদি অন্য কোন আয়াত দ্বারা করা যায় তবে তাকে অগ্রাধিকার দিতে হবে।
খ. যদি অন্য আয়াত দ্বারা কোন আয়াতের ব্যাখ্যা না করা যায় তবে দেখতে হবে রাসূলুল্লাহ (সা)-এর কোন ব্যাখ্যা করেছেন কিনা। যদি তিনি ব্যাখ্যা করে থাকেন তবে সে ব্যাখ্যাটি সঠিক। সে ক্ষেত্রে অন্য কোন মুফাসসিরের নিজস্ব মত ব্যক্ত করার কোন অধিকার নেই।
গ. যদি কোন আয়াতের ব্যাখ্যায় রাসূলুল্লাহ (সা)-এর মত না পাওয়া যায় তবে দেখতে হবে সাহাবা কিরাম আয়াতের ব্যাখ্যায় কি বুঝেছেন। তারা যে ব্যাখ্যাটি বুঝেছেন সেটিই হবে সঠিক। কেননা, তাঁরা রাসূলুল্লাহ (সা) থেকে সরাসরি কুরআন শুনার ও বোঝার সুযোগ লাভ করেছেন। যদি তাও না পাওয়া যায় তবে দেখতে হবে তাবিঈদের মত ও তাবে-তাবিঈদের মত।
কোন আয়াতের ব্যাখ্যায় যদি পূর্ববর্তী উত্তম যুগের কোন মুফাসসিরদের মত না পাওয়া যায় তখনই নতুন ব্যাখ্যা করার প্রয়োজন পড়ে। অন্যথায় নতুন ব্যাখ্যা প্রত্যাখ্যাত হবে।
অথবা হতে পারে কোন আয়াতের ব্যাখ্যা বোঝার ক্ষেত্রে সাহাবীগণ কিংবা তাবিঈগণ একাধিক মত পোষণ করেছেন আর সেক্ষেত্রে কারো পক্ষেই শক্তিশালী দলীল নেই, তখন তাঁদের যে কোন একটি মতকে চিন্তাভাবনার সাথে অগ্রাধিকার দেয়া যেতে পারে।
আর তাফসীর গ্রহণের ক্ষেত্রে ঐ সকল তাফসীর গ্রন্থকে অগ্রাধিকার দিতে হবে সেগুলোرواية এর ভিত্তিতে রচিত। তারপর অন্যান্য তাফসীরকে প্রাধান্য দিতে হবে।
উপরোক্ত মূলনীতির ািভত্তিতে وَابْتَغُوا إِلَيْهِ الْوَسِيلَةَ আয়াতের ব্যাখ্যায় বিভিন্ন তাফসীরের ভাষ্য ঃ
আল কুরআনে ‘ওয়াসিলা’ ঃ একটি তাত্ত্বিক বিশ্লেষণ
১. প্রাচীরতম পুরাতন তাফসীর ‘তাফসীরে ইবনে জাবীর আত তাবারী’-এর লেখক আল্লামা আবূ জাফর আত তাবারী (র) এ আয়াতের ব্যাখ্যায় বলেন,
(وَابْتَغُوا إِلَيْهِ الْوَسِيلَةَ) يقول : واطبلوا القربة إليه بالعمل بما يرضيه ـ (الطبرى ২/১৪২)
আল্লাহ যে সকল কাজে খুশী হন সে সকল কাজের মাধ্যমে তাঁর নৈকট্য অন্বেষণ কর। 
২. এ আয়াতের ব্যাখ্যায় সুপ্রসিদ্ধ বৃহৎ তাফসীরالجامع لأحكام القران এর প্রণেতা আল্লামা কুরতুবী (র) বলেন-
قوله تعالى (يَا أَيُّهَا الَّذِينَ آَمَنُوا اتَّقُوا اللَّهَ وَابْتَغُوا إِلَيْهِ الْوَسِيلَةَ) الوسيلة هىى القربة ـ عن أبى وائل والحسن ومجاهد وقتادة وعطاء والسدى ابن زيد وعبد الله بن كثير ـ إلى أن قال فالأصل الطلب … والوسيلة القربة التى ينبغى أن يطلب بها ، والوسيلة درجة فى الجنة …..”
“আল্লাহর বাণী يَا أَيُّهَا الَّذِينَ آَمَنُوا اتَّقُوا اللَّهَ وَابْتَغُوا إِلَيْهِ الْوَسِيلَةَ এখানে وسيلةঅর্থ হচ্ছেقربة বা নৈকট্য। হযরত আবূ ওয়ায়েল, হাসান, মুজাহিদ, কাতাদা, আতা, সুদ্দী, ইবন যায়িদ ও আবদুল্লাহ ইবন কাছীর থেকে এ অর্থ বর্ণিত হয়েছে। শেষ পর্যন্ত তিনি বলেন, মূলত এর অর্থ হচ্ছেالطلب অন্বেষণ করা। আরوسيلة অর্থ হচ্ছে ‘এমন নৈকট্য যার মাধ্যমে কোন কিছুর অন্বেষন করা সমীচীন হয়’ আবারوسيلة জান্নাতের একটা মর্যাদাসম্পন্ন অবস্থানের নাম।” 
৩. আয়াতে বর্ণিতوسيلة ব্যাখ্যায় হাদীসের আলোকে রচিত সর্বাধিক প্রসিদ্ধ তাফসীর গ্রন্থتفسير القران এর প্রণেতা আল্লামা ইবন কাসীর হযরত ইবন আব্বাস (রা) থেকে বর্ণনা করে বলেন-
عن ابن عباس رضي الله عنها أن معنى الوسيلة فيها القربة ونقل مثل ذلك عن مجاهد والحسن وعبد الله بن كثير والسدى وابن زيد وغير واحد ، ونقل عن قتادة قوله فيها : أى تقربوا إليه بطاعته والعمل بما يرضيه ـ ثم قال ابن كثير ـ وهذا الذى قاله هؤلاء الأئمة ، لا خلاف بين المفسرين فيه والوسيلة هى التى يتوصل بها إلى تحصيل المقصود “ـ
“হযরত ইবন আব্বাস (রা) থেকে বর্ণিত। তিনি বলেন যে, ওয়াসিলা অর্থ হচ্ছে “আল কুরবাহ” বা নৈকট্য। হযরত মুজাহিদ, হাসান, আবদুল্লাহ ইবন কাসীর, সুদ্দী, ইবন যায়িদসহ আরো অনেকে বলেছেন যে, আয়াতের অর্থ হলো- “তোমরা তার আনুগত্য করার মাধ্যমে এবং যে সকল কাজ তিনি খুশী হন তার মাধ্যমে তাঁর (আল্লাহর) নিকটবর্তী হও।”
এ কথাগুলো উল্লেখ করার পর ইমাম ইবন কাসীর (র) বলেন, এ সকল মহান ইমামগণ আয়াতের তাফসীরে এ কথাগুলোই বলেছেন। যে ব্যাপারে মুফাসসিরদের মাঝে কোন মতভেদ নেই…..।
এরপর বলেন, ‘ওয়াসিলা হচ্ছে এমন জিনিস যার মাধ্যমে উদ্দেশ্য হাসিল করা সম্ভব হয়।’ 
৪.أهل السنة والجماعة এর আকীদার আলোকে সর্বাধিক প্রসিদ্ধ তাফসীর গ্রন্থ,تيسير الكريم الرحمن এর প্রণেতাالشيخ عبد الرحمن السعدى এ আয়াতের তাফসীরে বলেন-
ابتغوا إليه الوسيلة أى القرب منه والحظوة لديه والحب له، وذلك بأداء فرائضه القلبية، كالحب له وفيه، والخوف والرجاء، والإنابة والتوكل. والبدنية: كالزكاة والحج. والمركبة من ذلك كالصلاة ونحوها، من أنواع القراءة والذكر، ومن أنواع الإحسان إلى الخلق بالمال والعلم والجاه، والبدن، والنصح لعباد الله، فكل هذه الأعمال تقرب إلى الله. ولا يزال العبد يتقرب بها إلى الله حتى يحبه الله، فإذا أحبه كان سمعه الذي يسمع به، وبصره الذي يبصر به، ويده التي يبطش بها، ورجله التي يمشي بها، ويستجيب الله له الدعاء
“তাঁর নৈকট্য লাভ করা, তাঁর কাছাকাছি হয়ে যাওয়া এবং তাকে ভালবাসা। আর এটা হবে মনের সাথে সংশ্লিষ্ট কতিপয় ফরয কাজ আদায় করার মাধ্যমে। যেমন, তাকে মহব্বত করা, ভয় করা, তার কাছে আশা করা, আশ্রয় নেয়া ও ভরসা করা। এবং শারীরিক কতগুলো ফরয কাজ পালন করার মাধ্যমে যেমন হাজ্জ ও যাকাত আদায় করা। এবং শরীর ও মন উভয়ের সমন্বয় ইবাদত পালন করার মাধ্যমে। যেমন সালাত ইত্যাদি আর হতে পারে সৃষ্টির প্রতি ইহসান করা। এ সকল কাজ বান্দাকে আল্লাহর নিকটবর্তী করে। এগুলো নিয়মিত করার মাধ্যমে বান্দা আল্লাহর তখন যেন তার কান যা দিয়ে তিনি শোনেন; তার চোখ যা দিয়ে তিনি দেখেন, তার হাত যা দিয়ে তিনি ধরেন, তার পা যা দিয়ে তিনি হাটেন। সবকিছু তাঁর (আল্লাহর) অনুগত হয়ে যায়। আর আল্লাহ তার দু’আ কবুল করেন।” 
৫. আধুনিক বিশ্বে কুরআন দিয়ে কুরআনের তাফসীর হিসেবে বিখ্যাত তাফসীর গ্রন্থأضواء البيان এর প্রণেতা আল্লামাالأمين الشنقيطى এ আয়াতের তাফসীরে বলেন-
اعلم أن جمهور العلماء على أن المراد بالوسيلة هنا هو القربة إلى الله تعالى بامتثال أوامره ، واجتناب نواهيه على وفق ما جاء به محمد صلى الله عليه وسلم بإخلاص في ذلك لله تعالى ؛ لأن هذا وحده هو الطريق الموصلة إلى رضى الله تعالى ، ونيل ما عنده من خير الدنيا والآخرة . 
وأصل الوسيلة : الطريق التي تقرب إلى الشيء ، وتوصل إليه وهي العمل الصالح بإجماع العلماء ؛ لأنه لا وسيلة إلى الله تعالى إلا باتباع رسوله صلى الله عليه وسلم ، وعلى هذا فالآيات المبينة للمراد من الوسيلة كثيرة جدّاً كقوله تعالى : ( وَمَآ ءَاتَـٰكُمُ ٱلرَّسُولُ فَخُذُوهُ وَمَا نَهَـٰكُمْ عَنْهُ فَٱنتَهُواْ ) ، وكقوله : ( قُلْ إِن كُنتُمْ تُحِبُّونَ ٱللَّهَ فَٱتَّبِعُونِى ) ، وقوله : ( قُلْ أَطِيعُواْ ٱللَّهَ وَأَطِيعُواْ ٱلرَّسُولَ ) ، إلى غير ذلك من الآيات 
“জেনে রেখ। অধিকাংশ উলামা এ মত পোষণ করেন যে, এখানে ‘ওয়াসিলা’ দ্বারা উদ্দেশ্য হলো, আল্লাহ তাআলার বিধি-বিধান পালন করা ও তাঁর নিষেধাজ্ঞাবলী পরিহার করার মাধ্যমে তাঁর নৈকট্য লাভ করা। এটা হবে একমাত্র আল্লাহর জন্য নিষ্ঠা ও আন্তরিকতার সাথ এবং মুহাম্মদ (সা) এর প্রদর্শিত পদ্ধতি অনুযায়ী। কেননা আল্লাহর সন্তুষ্টি পাবার জন্য এবং তাঁর কাছ দুনিয়া ও আখিরাতের কল্যাণ পাবার জন্য এটাই একমাত্র সঠিক পথ। এর বাইরে কোন পদ্ধতি নেই।
ওয়াসিলার মূল কথা হলো, এমন পদ্ধতি বা পথের নাম যা কোন কিছুর নিকটবর্তী করে দেয় এবং তার নিকটে পৌ*ছে দেয়। আর সকল উলামা একমত যে, এর অর্থ হচ্ছে, নেকআমল। কেননা আল্লাহর ও রাসূলের অনুসরণ ব্যতীত কোন ওয়াসিলা হতে পারে না।
এর উপর ভিত্তি করে যে সকল আয়াত ওয়াসিলার উদ্দেশ্য বর্ণনা করতে সহায়ক তা অনেক। যেমন আল্লাহ বলেন-
وَمَا آتَاكُمْ الرَّسُولُ فَخُذُوهُ وَمَا نَهَاكُمْ عَنْهُ فَانْتَهُوا (الحشر: ৭) .
“রাসূল (সা) যা কিছু নিয়ে তোমাদের কাছে এসেছেন তোমরা তা গ্রহণ কর। আর যা করতে নিষেধ করেছেন তা পরিহার কর।” 
আল্লাহ তায়ালা আরো বলেন-
قُلْ إِنْ كُنتُمْ تُحِبُّوْنَ اللَّهَ فَاتَّبِعُونِي (ال عمران : ৩৯)
“বল, যদি তোমরা আল্লাহকে ভালবাসতে চাও তবে আমার অনুসরণ করে চল।” 
তিনি আরো বলেন :
قُلْ أَطِيعُوا اللَّهَ وَأَطِيعُوا الرَّسُولَ (النور: ৩০)
“বল, যদি তোমরা আল্লাহর অনুসরণ কর এবং রাসূলের অনুসরণ কর।” 
এ সম্পর্কে এ ছাড়াও অনেক আয়াত বর্ণিত হয়েছে।
এমনিভাবে গোটা পৃথিবী জুড়ে খ্যাত এবং আহলুস সুন্নাহ ওয়াল জামাআতের নিকট সর্বাধিক গ্রহণযোগ্য তাফসীরুল কুরআনের গ্রন্থসমূহ থেকে এ যাবত। وَابْتَغُوا إِلَيْهِ الْوَسِيلَةَ আয়াতের ব্যাপারে যে তাফসীর উল্লেখ করা হল তার মূলকথা হচ্ছে ঃ
১.وسيلة অর্থ নেকআমল। যেমন-সালাত, সাওম, হজ্জ, যাকাত, দান-সাদাকা, দুআ, প্রার্থনা, মান্নত, ভাল ব্যবহার, পরোপকার ইত্যাদি সবকিছু।
২. ওয়াসিলার সঠিক ব্যাখ্যা এটাই যা মুফাসসিরীন থেকে বর্ণিত।
৩. ওয়াসিলা মানে পীর এমন কথা কোন গ্রহণযোগ্য মুফাসসির বলেননি। কোন সাহাবা ও তাবিঈ থেকে এমন তাফসীর পাওয়া যায় না। যারা কুরআনকে সবচেয়ে বেশি বুঝতেন।
৪. ‘আমলে সালেহ’ হলো ওয়াসিলা। তা রাসূলুল্লাহ (সা)-এর দেখানো পদ্ধতিতে হতে হবে। মন গড়া কোন পদ্ধতিতে নয়।
৫. সকল ‘আমলে সালিহ’ এর মাঝে তথা ‘একমাত্র আল্লাহর সন্তুষ্টির জন্যে’ করার নিয়্যত থাকতে হবে, না হলে তা গ্রহণযোগ্য নয়।
ওয়াসিলার ব্যাপারে ভ্রান্ত তাফসীর ও তার জবাব
আল্লাহ তাআলার বাণী ঃ وَابْتَغُوا إِلَيْهِ الْوَسِيلَةَ এর ব্যাখ্যা করতে গিয়ে কতিপয় আলেম তাদের মনগড়া ব্যাখ্যা প্রদান করেছেন। এক্ষেত্রে তাঁরা কোন দলীলের তোয়াক্কা করেননি বরং তাঁদের ধারণাপ্রসূত ব্যাখ্যা তৈরী করেছেন। আর অপব্যাখ্যা করে তাঁরা এক দিকে নিজেদের ক্ষতি করছেন আর অনেক সাধারণ লোকের ক্ষতি করছেন। এ আয়াত দ্বারা দলীল গ্রহণ করে যে সকল কাজকে তারা বৈধ বলেন তন্মধ্যে উল্লেখযোগ্য হলো-
১. নবীদের ব্যক্তি সত্তাকে দুআ কবুলের জন্য ওয়াসিলা বা মাধ্যম বানানো বৈধ। যেমন কেউ বলল- “হে আল্লাহ! মুহাম্মদ (সা)-এর ওয়াসিলায় আমার দুআ কবুল কর।”
২. সালিহীন বা নেককারদের ওয়াসিলা করে কোন দুআ কবুলের জন্য আল্লাহর কাছে ধর্ণা দেয়া বৈধ।
৩. ওয়াসিলা মানে পীর। সুতরাং আয়াতের অর্থ হয় যে, আল্লাহর নৈকট্য লাভের জন্য পীর ধরা। কেননা তিনি মুরীদকে আল্লাহর নিকটবর্তী করে দেয়ার মাধ্যম হিসেবে কাজ করেন।
অথবা, পীর হলো আল্লাহর নিকটতম লোক। অন্যান্য বান্দারা সরাসরি আল্লাহর নৈকট্য লাভে ব্যর্থ। তাই আল্লাহর নিকটবর্তী লোক অর্থাৎ পীরকে মাধ্যম হিসেবে গ্রহণ করতে হবে। স্বয়ং আল্লাহ সে কথা উক্ত আয়াতে ঘোষণা করেছেন।
এ সকল তাফসীরের সবগুলো মনগড়া। কারণ, আয়াতের এ তাফসীর করার ব্যাপারে না আছে কুরআনের অন্য কোন দলীল, না আছে কোন একটা হাদীস, না আছে কোন সাহাবীর অভিমত আর না আছে জ্ঞানী লোকের চিন্তা। নির্ভরযোগ্য কোন তথ্যই তাদের এ তাফসীর সমর্থন করে না।
তাহলে এটা কোন ধরনের ব্যাখ্যা? যা রাসূলুল্লাহ (সা) বলেননি সাহাবীরা বলেননি ও তাবিঈগণ বলেননি? এটা নিশ্চয় ভ্রান্ত ব্যাখ্যা।
প্রথম ও দ্বিতীয় তাফসীর
এবারে দেখা যাক, প্রথম ও দ্বিতীয় তাফসীর অর্থাৎ নবী ও সালিহ ব্যক্তিদের সত্তাকে তাআলার কাছে দুআ কবুলের জন্য ওয়াসিলা বানানো কুরআন সমর্থন করে কি না?
আল্লাহ তায়ালার কাছে দুআ করার ক্ষেত্রে কোন ব্যক্তিকে মাধ্যম বানানো বৈধ নয়। এ সম্পর্কে আল্লাহ তায়ালা বলেন-
ক.اَدْعُوْنِىْ اسْتَجِبْ لَكُمْ (المؤمن: ৬) 
“তোমরা আমার কাছে দুআ কর আমি তোমাদের দুআ কবুল করব।” 
খ. দুআ হলো ইবাদত। আইয়ামে জাহেলিয়াতে মুশরিকরা প্রতিমা পূজা করত। তাদের উদ্দেশ্য ছিল যে, এ প্রতিমারা আল্লাহর নিকটবর্তী একদল সত্তা। ততাই তাদের ইবাদত করলে তারা মাধ্যম হয়ে তাদেরকে আল্লাহর নিকটবর্তী করে িিদবে। এ ধারণাকে আল্লাাহ তাআলা শিরক বলে উল্লেখ করেছেন এবং তাদের নিন্দা করেছেন। আল্লাহ তাদের নিন্দাকরণ প্রসঙ্গে বলেন-
مَا نَعْبُدُهُمْ إِلَّا لِيُقَرِّبُونَا إِلَى اللَّهِ زُلْفَى .
“(মুশরিকরা বলে) আমরা তাদের (প্রতিমাগুলোর) ইবাদত এজন্য করি যাতে তারা আমাদেরকে আল্লাহর নিকটবর্তী করে দেয়। 
আয়াত থেকে বোঝা গেল আল্লাহর ইবাদত করতে হবে সরাসরি। কোন মাধ্যম গ্রহণ করে নয়। যদি এমনটি করা হয় তা হবে শিরক। সুতরাং দুআ যেহেতু ইবাদত তাই তা সরাসরি আল্লাহর কাছেই করতে হবে।
গ. রাসূলুল্লাহ (সা) দীর্ঘ এক হাদীসে বলেন-
إذا سألت فاسئل الله وإذا استعنت فاستعن بالله
“যখন কিছু চাইবে তখন একমাত্র আল্লাহর কাছেই চাইবে আর যখন কোন সাহায্য পেতে চাও তখন একমাত্র আল্লাহর কাছেই সাহায্য প্রার্থনা করবে।” 
ঘ. কি কারণে দুআর ক্ষেত্রে আল্লাহ ও বান্দার মাঝে মধ্যস্থতা প্রয়োজন হবে? আল্লাহ কি মানুষ থেকে অনেক দূরে? তিনি কি তার বিস্তারিত অবস্থা জানেন না? তিনি কি তার দুআ শুনতে পান না? অবশ্যই তিনি বান্দার অনেক কাছে। খুব বেশি নিকটবর্তী সুতরাং কোন মধ্যস্থতার দরকার নেই। মহান আল্লাহ বলেন-
نَحْنُ اَقْرَبُ إِلَيْهِ مِنْ حَبْلِ الْوَرِيْدِ 
“আমরা তার (বান্দার) ঘাড়ের শাহরগের চেয়েও বেশি নিকটবর্তী।” 
আল্লাহ স্বীয় বান্দাকে তার পিতামাতা থেকে বেশি ভালবাসেন। তাদের চেয়ে বেশি, রহম করেন। সুতরাং দুআর ক্ষেত্রে কোন কাউকে মাধ্যম বানানোর কোন প্রংোজন নেই।
চ. একাজে যাদেরকে ওয়াসিলা বানানো হয় তারা নিজেরাই তো এমন ব্যক্তিত্ব যারা আল্লাহর নিকটবর্তী হবার জন্য মাধ্যম খোঁজে আর তা হলো আমলে সালিহ বা ভাল কাজ।
অতএব যারা নিজেরাই মুখাপেক্ষী তারা আবার অন্যের সমস্যা পূরণে কিভাবে ভূমিকা গ্রহণ করতে পারে?
আল্লাহ তাআলা এ ধরনের কাজকে নিন্দা করে বলেন-
أُولَٰئِكَ الَّذِينَ يَدْعُونَ يَبْتَغُونَ إِلَىٰ رَبِّهِمُ الْوَسِيلَةَ أَيُّهُمْ أَقْرَبُ وَيَرْجُونَ رَحْمَتَهُ وَيَخَافُونَ عَذَابَهُ ۚ إِنَّ عَذَابَ رَبِّكَ كَانَ مَحْذُورًا (بنى اسرائيل: ৫৮)
“যাদেরকে তারা আহবান করেন, তাঁরা নিজেরাই তাদের পালনকর্তা নৈকট্য লাভের জন্য মধ্যস্থতা তালাশ করে যে, তাদের মধ্যে কে নৈকট্যশালী। তারা তার রহমাতের আশা করে আর তাঁর শাস্তিকে ভয় করে। নিশ্চয় আপনার পালনকর্তার শাস্তি ভয়াবহ।” 
উল্লিখিত প্রমাণাদি ও যৌক্তিক বক্তব্যের আলোকে এ সিদ্ধান্তে উপনীত হওয়া সম্ভব যে, দুআ কবুলের ক্ষেত্রে কিংবা আল্লাহর নৈকট্য লাভের জন্য কোন ব্যক্তি সত্তাকে মাধ্যম বা ওয়াসিলা বানানো বৈধ নয় হতে পারে না।
সুতরাং যারা আয়াতের তাফসীরে বলেন যে,وسيلة অর্থ দুআ কবুলের ক্ষেত্রে অন্য কোন ব্যক্তিকে মাধ্যম বানানো সে তাফসীর ভ্রান্ত ও সুস্পষ্ট ভুল। এ প্রসঙ্গে বিখ্যাত মুফাসসির মাহমূদ আলূসী (র) তাঁর তাফসীর গ্রন্থ ‘রুহুল মাআনী’ তে বলেন ঃ
واستدل بعض الناس بهذه الآية على مشروعية الاستغاثة بالصالحين وجعلهم وسيلة بين الله تعالى وبين العباد، والقسم على الله تعالى بهم بأن يقال: اللهم إنا نقسم عليك بفلان أن تعطينا كذا، ومنهم من يقول للغائب أو الميت من عباد الله تعالى الصالحين: يا فلان، ادع الله تعالى ليرزقني كذا وكذا، ويزعمون أن ذلك من باب ابتغاء الوسيلة، ويروون عن النبي صلى الله عليه وسلم أنه قال: “إذا أعيتكم الأمور فعليكم بأهل القبور، أو فاستغيثوا بأهل القبور”. وكل بعيد عن الحق بمراحل. (روح المعانى ـ ৫/১২০)
“অনেকে এ আয়াত দ্বারা নেককার ব্যক্তিদের মাধ্যমে সাহায্য প্রার্থনা ও তাদেরকে আল্লাহ ও বান্দার মাঝে মাধ্যম বানানোর ব্যাপারে দলীল হিসেবে গ্রহণ করেছে। তারা তাদের নামে কসম করার পক্ষেও দলীল মনে করেছে। যেমন তারা বলে “হে আল্লাহ আমি অমুক নেককার ব্যক্তির কসম করে বলছি যে, আপনি আমাকে এমন এমন জিনিস দান করুন। আবার মানুষের মাজে একদল এমন আছে যারা মৃত কিংবা জীবিত নেককার লোককে বলে, হে অমুকব ব্যক্তি আপনি আল্লাহর কাছে আমার জন্য এমন এমন সম্পদ/রিযিক এর জন্য দুআ করুন। এ ক্ষেত্রে তারা ধারণা করে যে, এটা হচ্ছে এর নামান্তর। তারা তাদের পক্ষে রাসূলুল্লাহ (সা) থেকে হাদীস বর্ণনা করে বলে যে, তিনি বলেছেন ঃ “যখন তোমাদের কোন ব্যাপার সমস্যা হয়ে দেখা দেয় তখন তোমরা কবরবাসীর কাছে সাহায্য প্রার্থনা কর।” এ ধরনের সকল বক্তব্য সত্য থেকে বহুগুণে দূরে।” 
ইমাম আলূসী (র) আরো বলেন ঃ
وتحقيق الكلام في هذا المقام أن الاستغاثة بمخلوق وجعله وسيلة بمعنى طلب الدعاء منه لا شك في جوازه إن كان المطلوب منه حياًوأما إذا كان المطلوب منه ميتاً أو غائباً فلا يستريب عالم أنه غير جائز، وأنه من البدع التي لم يفعلها أحد من السلف
“এ ব্যাপারে গবেষণালব্ধ মূলকথা হচ্ছে এই যে, কোন জীবিত ব্যক্তি থেকে দুআ চাওয়ার অথেاستغاثة বা সাহায্য প্রার্থনা করা এবং তাকে ওয়াসিলা মনে করা বৈধ হবার ব্যাপারে কোন দ্বিমত নেই। আর, যার কাছে দুআ চাওয়া হচ্ছে সে যদি মৃত হয়ে থাকে তবে কোন আলিমই এটা না জায়িয হবার ব্যাপারে দ্বিমত পোষণ করেন না। এটা এমন বিদআত যে, পূর্বের কোন সালফে সালিহীন এমনটি করেননি।” 
তৃতীয় তাফসীর 
এ আয়াতের তৃতীয় যে মনগড়া তাফসীরটি করা হয় তা হচ্ছে,وسيلة মানে পীর অর্থাৎ এ আয়াতে আল্লাহ বলেছেন ঃ
يَا أَيُّهَا الَّذِينَ آَمَنُوا اتَّقُوا اللَّهَ وَابْتَغُوا إِلَيْهِ الْوَسِيلَةَ
“হে মুমিনগণ! তোমরা আল্লাহকে ভয় কর আর তার প্রতি মাধ্যম তালাশ কর।” আর এ মাধ্যম হলো পীর।
এ তাফসীর মনগড়া, বাতিল, অস্তিত্বহীন, এর সাথে কোনভাবেই যে ইসলামের কোন সম্পর্ক নেই তার প্রমাণ হিসেবে আমরা নি¤œলিখিত কতগুলো যুক্তি পেশ করা যেতে পারেঃ
১. আল কুরআনের যে কোন আয়াতের ব্যাখ্যার ক্ষেত্রে রাসূলুল্লাহ (সা) কর্তৃক প্রদত্ত ব্যাখ্যাই হলো সঠিক। এ আয়াতের وسيلة শব্দের অর্থ পীর এমন কোন ব্যাখ্যা রাসূলুল্লাহ (সা) প্রদান করেননি।
২. আয়াতের তাফসীরের ক্ষেত্রে রাসূলুল্লাহ (সা)-এর পরেই সাহাবীদের স্থান। তাদের কথা এ ক্ষেত্রে সর্বাধিক গ্রহণযোগ্য। কারণ, তারা রাসূলুল্লাহ (সা)-এর থেকে সরাসরি কুরআন বোঝার ও জানার সুযোগ পেয়েছেন। কোন আয়াতের অর্থ, ব্যাখ্যা বুঝতে তাদের যখনই সমস্যা হয়েছে তখনই তারা রাসূলুল্লাহ (সা)-কে সে আয়াতের ব্যাপারে জিজ্ঞেস করেছেন এবং কুরআন বুঝে বুঝে তারা সামনে অগ্রসর হয়েছেন।
বর্ণিত আয়াতের ব্যাপারে রাসূলুল্লাহ (সা) থেকে কোন হাদীস বর্ণিত না পাওয়া গেলেও সাহাবীদের থেকে এর ব্যাখ্যা জানা যায়। তাঁরা وسيلة শব্দের অর্থ বর্ণনায় বলেছেন যে, এর অর্থ “আমলে সালিহ” তথা নেক কাজ। পীর বা অলী নয়। এর অর্থ যদি পীর হত তবে সাহাবীরা তা বুঝতেন এবং বর্ণনা করতেন।
৩. সাহাবীদের পর যারা কুরআনকে সবচেয়ে বেশি বুঝেছেন তাঁরা হলেন তাবিঈগণ। যেহেতা তারা রাসূলুল্লাহ (সা)-এর সবচেয়ে নিকটবর্তী স্তর। যাদের সম্পর্কে রাসূলুল্লাহ (সা) বলেছেন-
خير أمتي قرني ثم الذين يلونهم ثم الذين يلونهم 
“আমার উম্মতের মাঝে সর্বোত্তম হচ্ছে আমার যুগ। এরপর উত্তম হচ্ছে তার পরবর্তী যুগ এবং তার পরবর্তী যুগ।” 
আর তাঁদের মধ্যে মুফাসসির ছিলেন তাঁরাও এ আয়াতের ব্যাখ্যায় وسيلة অর্থ বলেছেনعمل صالح (নেককাজ)। পীর বা দরবেশ নয়।
৪. যে আয়াতে وسيلة শব্দ রয়েছে সে আয়াত নিয়ে যদি গবেষণা করা যায় তবে দেখা যায় যে, আয়াতে আল্লাহ তাআলা প্রথমত মুমিনদেরকে সম্বোধন করেছেন। যার মধ্যে নবী করীম (সা) সহ সকল মুমিনই শামিল। এরপর তিনি তাদেরকে তিনটি কাজের কথা বলেছেন। তা হচ্ছেঃ
ক.اتقوا الله তোমার আল্লাহকে ভয় কর।
খ.وابتغوا إليه الوسيلة তোমার ভাল কাজের মাধ্যমে তাঁর নৈকট্য লাভ কর।
গ.وجاهدوا فى سبيله তোমরা তাঁর পথে সংগ্রাম কর।
এখানে وسيلة অর্থ ভাল কাজ বা সৎকাজ অর্থ করলেই নবী (সা) সহ সকলের জন্য আয়াতটি প্রযোজ্য হয়। আর যদি وسيلة মানে ‘পীর’ বলি তবে প্রশ্ন হয়ে দাঁড়ায় যে, নবী করীম (সা) এর পীর বা وسيلة কে হতেন? কে ছিলেন তার পীর?
সুতরাং আয়াতের প্রসঙ্গ বলছে যে, وسيلة মানে পীর হওয়াটা কোন প্রকার যুক্তিতে গ্রাহ্য হয় না।
৫. وسيلة অর্থ যে পীর হতে পারে না সে প্রসঙ্গে আলোচনায় এবং বর্তমানে আয়াতের ব্যাখ্যা করতে গিয়ে علامة الشنقيطىতাঁর লিখিত তাফসীরأضواء البيان এ বলেন-
بهذا التحقيق تعلم أن ما يزعمه كثير من ملاحدة أتباع الجهَّال المدعين للتصوُّف من أن المراد بالوسيلة في الآية الشيخ الذي يكون له واسطة بينه وبين ربه : أنه تخبط في الجهل والعمى وضلال مبين ، وتلاعب بكتاب الله تعالى ، واتخاذ الوسائط من دون الله من أصول كفر الكفار ، كما صرح به تعالى في قوله عنهم : ( مَا نَعْبُدُهُمْ إِلاَّ لِيُقَرِّبُونَآ إِلَى ٱللَّهِ زُلْفَىۤ ) وقوله : ( وَيَقُولُونَ هَـٰؤُلاۤءِ شُفَعَـٰؤُنَا عِندَ ٱللَّهِ قُلْ أَتُنَبِّئُونَ ٱللَّهَ بِمَا لاَ يَعْلَمُ فِى ٱلسَّمَـوَتِ وَلاَ في ٱلأرْضِ سُبْحَانَهُ وَتَعَالَىٰ عَمَّا يُشْرِكُونَ ) (يونس:১৮)
فيجب على كل مكلف أن يعلم أن الطريق الموصلة إلى رِضى الله وجنته ورحمته هي اتباع رسوله صلى الله عليه وسلم ، ومن حاد عن ذلك فقد ضل سواء السبيل ، ( لَّيْسَ بِأَمَـٰنِيِّكُمْ وَلاۤ أَمَانِىِّ أَهْلِ ٱلْكِتَابِ مَن يَعْمَلْ سُوۤءًا يُجْزَ بِهِ ) (سورة النساء: ১২৩) (أضواء البيان ، ৪-৮৮)
“এসব সূক্ষ্মাতিসূক্ষ্ম পর্যালোচনার পর বোঝা যায় যে, তথাকথিত সূফীবাদ ও পীরবাদের দাবীদার একদল মূর্খ ও বিদআতী লোক বলে থাকেন যে, ওয়াসিলা অর্থ হচ্ছে পীর যিনি তার ও আল্লাহর মাঝে মাধ্যম হন। এ ধরনের অর্থ করাটা চরম মূর্খতা, দ্বীনের জ্ঞানে অন্ধত্ব, সুস্পষ্ট গোমরাহী এবং আল্লাহর কিতাব নিয়ে যেন খেল তামাশার শামিল। আল্লাহ ছাড়া অন্য কাউকে মাধ্যম হিসেবে গ্রহণ করা কাফিরদের কুফরী মূলনীতির অন্তর্গত। যেমনটি আল্লাহ তাআলা কুরআনে উল্লেখ করেছেন। তাদের সম্পর্কে আল্লাহ বলেন, তারা বলে, “আমরা তাদের (মূর্তিদের) উপাসনা করছি এজন্য যে, তারা আমাদেরকে আল্লাহর একান্ত নিকটবর্তী করে দেবে।” আল্লাহ আরো বলেন ঃ “তারা বলে যে, এগুলো (মূর্তিগুলো) আমাদের জন্য আল্লাহর নিকট সুপারিশকারী। হে রাসূলুল্লাহ (সা) আপনি বলুন, তোমরা কি তাদেরকে আল্লাহর সমকক্ষ বানাচ্ছ যারা আসমান, যমীনে কি আছে সে সম্পর্কে- কিছুই জানে না। তারা যা কিছু শিরক করছে তা থেকে তিনি পবিত্র ও মহান।” 
অতএব, প্রত্যেক বয়ঃপ্রাপ্ত মুসলিমের উপর এ কথা জানা ওয়াজিব যে, আল্লাহর সন্তুষ্টি, তাঁর জান্নাত ও রহমত পাবার একমাত্র সঠিক পথ হলো তাঁর রাসূলের অনুসরণ করা, যে এর বিরোধিতা করবে সে চরমভাবে পথভ্রষ্ট হলো। আল্লাহ বলেন, “তোমাদের আকাক্সক্ষাও ঠিক নয়, আবার আহলে কিতাবের আকাক্সক্ষাও ঠিক নয়, যে মন্দ করবে সে তার যথাযথ ফল পাবে।” 
৬. এ সমস্ত দলীল প্রমাণের ভিত্তিতে এ কথা স্পষ্টভাবে বলা যায় যে, আল্লাহর সাথে বান্দার সম্পর্ক হচ্ছে সরাসরি। সে ক্ষেত্রে কোন মাধ্যম প্রয়োজন নেই। কেননা আল্লাহর বান্দার সব কথা শুনেন ও দেখেন। এ কারণে আল্লাহ যত বিধি-বিধান নাযিল করেছেন সে সকল ব্যাপারেই মুমিনদের সরাসরি সম্বোধন করে বলেছেন, তোমরা আমার বিধি-নিষেধ যথাযথ পালন কর। মানুষের বৈশিষ্ট্য থেকে মহান আল্লাহ তাআলার বৈশিষ্ট্য স্বতন্ত্র ও পৃথক, তার প্রমাণ হচ্ছে এই যে,
রাজন্যবর্গের নিকটবর্তী হতে মানুষকে মাধ্যম ধরতে হয়। কেননা, রাজা বাদশাহগণ সকলকে চিনেন না আর সকলের ব্যাপারে তাদের জ্ঞান সীমিত। পক্ষান্তরে আল্লাহর কাছে মাধ্যমের প্রয়োজন নেই। কেননা, তিনি সকলকেই চিনেন এবং জানেন। তার জ্ঞান অসীম। সুতরাং কাউকে মাধ্যম গ্রহণ করার প্রশ্নই উঠে না।
৭. যে পীর বা দরবেশ আল্লাহ ও মানুষের মাঝে মাধ্যম হবেন তিনি কি নিজের ব্যাপারে এ গ্যারান্টি দিতে পারেন যে, তিনি আল্লাহর কাছে মুক্তি পাবেনই। যেহেতু কোন পীর এ গ্যারান্টি দিতে পারেন না যে, তিনি আল্লাহর নিকট মুক্তিপ্রাপ্ত, সেহেতু তিনি وسيلة বা মাধ্যম হতে পারেন না।
মোট কথা وسيلة অর্থ এমন সব ভাল কাজ যা মানুষকে আল্লাহর নৈকট্য লাভে সহায়ক। যা মানুষকে আল্লাহর নিকটবর্তী করে দেয়।
وسيلة অর্থ পীর বা অলী- এ অর্থ ও তাফসীর করা সুস্পষ্ট ভ্রান্তি তাতে কোন সন্দেহ নেই। যা ইতিপূর্বের দলীল ভিত্তিক আলোচনায় প্রমাণিত হয়েছে। তবে হক্কানী পীর বুযুর্গ এবং অলী আল্লাহগণ উস্তাদ হিসেবে সাধারণ মানুষকে আল্লাহর দেয়া বিধি-নিষেধ এবং নবী করীম (সা)-এর সুন্নাহর ভিত্তিতে জীবন-যাপন করার জন্য উজ্জীবিত করেন এবং এ বিষয়ে নিয়মিত অনুশীলন করিয়ে থাকেন। আল্লাহ তাআলা আমাদের কুরআন ও সুন্নাহর সঠিক বুঝ দান করুন। আমীন!

nibrasbd