নিবরাস বৃন্ত থেকে ঝরে পড়া এক ফুটন্ত গোলাপ ড. শায়খ মুস্তাফিজুর রহমান (রাহ:)

একদল আলোকিত মানুষের একটি বৃন্ত নিবরাস ফাউন্ডেশন বাংলাদেশ। দেশ-বিদেশে অবস্থিত বাংলাদেশী একদল সাদা মনের মানুষের সংগঠন এ প্রতিষ্ঠান। যার অন্যতম ছিলেন শায়খ ড. মো. মুস্তাফিজুর রহমান (র.)। তিনি ছিলেন একাধারে সুলেখক, গবেষক, বিনয়ী, স্পষ্টভাষী, সত্য প্রকাশে নির্ভীক, নির্লোভ, সদালাপী, হাস্যোজ্জ্বল ও পরোপকারী। তাঁর অকৃত্রিম হাসি ও দরদমাখা ব্যবহার এবং মানুষকে আপন করে নেয়ার বিষয়টি সকলকে বিমোহিত করতো। তিনি জ্ঞানে-গুণে, প্রজ্ঞা- পাণ্ডিত্যে, মেধা-মননে, চলনে-বলনে ছিলেন ব্যতিক্রম এক ব্যক্তিত্ব। তিনি ২০০৮ সাল হতে নিবরাস ফাউন্ডেশন বাংলাদেশ‘র সাথে ওতপ্রোতভাবে জড়িত থেকে বিভিন্ন পর্যায়ে দায়িত্ব পালন করেছেন। তিনি ছিলেন শিক্ষার্থী, শিক্ষক ও শিশুদের জন্য প্রেরণার উৎস এবং অনুকরণীয় দৃষ্টান্ত। মহান আল্লাহর ডাকে সাড়া দিয়ে তিনি ইতোমধ্যে দুনিয়া থেকে বিদায় নিয়েছেন। নিবরাস এর ১০১টি ফুল থেকে ঝড়ে পড়া প্রথম ফুল।
ব্যক্তিগত পরিচিতি:
ড. শায়খ মুস্তাফিজুর রহমান ১৯৬৫ সালে মাদারীপুর জেলার কালকিনি থানাধীন কয়ারিয়া গ্রামের এক সম্ভ্রান্ত মুসলিম পরিবারে জন্মগ্রহণ করেন। তাঁর পিতার নাম মো: মফসেরুদ্দিন মৃধা ও মাতার নাম রাশিদা বেগম। মোট চার ভাইয়ের মধ্যে তিনি সর্বকনিষ্ঠ। তিনি স্ত্রী ও পাঁচ সন্তান রেখে দুনিয়া থেকে বিদায় নিয়েছেন। সন্তানদের মধ্যে ৩ জন ছেলে ও ২ জন মেয়ে। প্রত্যেকেই এখনও লেখাপড়া করছে। বড় ছেলে প্যারামেডিকেল কোর্স সম্পন্ন করেছে। বাকীরা সকলে বিভিন্ন পর্যায়ে অধ্যয়নরত। তাঁর স্ত্রী গৃহিনী এবং উচ্চশিক্ষিত একজন নারী । যিনি একজন আদর্শ গৃহিনী হিসেবে দায়িত্ব পালন করছেন ।
প্রকাশিত গ্রন্থসমূহ :
ড. শায়খ মুস্তাফিজুর রহমান অনেকগুলো মৌলিক গ্রন্থ রচনা করেছেন। তন্মধ্যে উল্লেখযোগ্য হলো-
১. আল-কুরআনের আয়াতের অভিধান
২. মুফরাদাতুল কুরআন
৩. কালিমাতুল কুরআন
৪. কুরআনের পরিসংখ্যান
৫. বিলাদী বাংলাদেশ
৬. সোনামণিদের সচিত্র আরবী শিক্ষা
৭. আরব জাহান পরিচিতি
৮. আলাউদ্দীন আল আযহারী : জীবন ও কর্ম
৯. ইসলামিয়াত ৯ম-১০ম
১০. শাহ নিয়ামত উল্লাহর ভবিষ্যৎ বাণী, ইত্যাদি।
.
শিক্ষা ও কর্মময় জীবন :
তিনি ১৯৮১ সালে প্রাথমিক বৃত্তি লাভ করেন। মাদরাসা-ইআলিয়া, ঢাকা থেকে ১৯৮৯ সালে হাদিস, ১৯৯১ সালে আদব, ১৯৯৫ সালে তাফসির, ১৯৯৮ সালে গাজীপুর জেলার কালিগঞ্জ থানার দূর্বাটি আলিয়া মাদরাসা থেকে ফিকহ বিভাগে কৃতিত্বের সাথে কামিল পাসের পাশাপাশি ১৯৯১ সালে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের আরবী বিভাগ থেকে স্নাতক সম্মান, ১৯৯২ সালে স্নাতকোত্তর (আধুনিক আরবী) ও ২০০৪ সালে পিএইচডি ডিগ্রি অর্জন করেন। এছাড়াও তিনি একই বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ১৯৯১ সালে ডিপ্লোমা ইন অ্যারাবিক, ১৯৯২ সালে হায়ার ডিপ্লোমা ইন অ্যারাবিক, ১৯৯২ সালে দারুল ইহসান বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ডিপ্লোমা ইন ইসলামিক স্টাডিজ অ্যান্ড দাওয়াহ, ২০০৮ সালে ইসলামিক ফাউন্ডেশন বাংলাদেশ থেকে অনুবাদ দক্ষতা সনদ অর্জন করেন।
কর্মজীবনে তিনি বিভিন্ন পর্যায়ে গুরুত্বপূর্ণ দায়িত্ব পালন করেছেন। রাজকীয় সৌদী দূতাবাসের অনুবাদক হিসেবে প্রায় ১৪ বছর দায়িত্ব পালন করেছেন। এটিই ছিল তাঁর মূল পেশা। এছাড়াও তিনি বিভিন্ন জামে মসজিদের ইমাম ও খতীব হিসেবে দায়িত্ব পালন করেছেন । আইআইআরও এর দাওয়াহ প্রশিক্ষণ প্রকল্পের উপ-পরিচালক হিসেবেও তিনি কিছুদিন দায়িত্ব পালন করেন। শিক্ষাক্ষেত্রে রহমতে আলম ইসলামী মিশন ও বালক কামিল মাদরাসা, তেজগাঁও, ফায়দাবাদ আসগারুল উলুম সিনিয়র মাদরাসা, উত্তরা ও হযরতবাগ ইসলামিয়া আসিসর মাদরাসা, লালবাগ, সরকারি মাদ্রাসাই আলিয়া ঢাকায় জিনি আরবী বিষয়ে অধ্যাপনা করেন (১৯৯৩-২০০৪)। বাংলাদেশ বেতার বহির্বিশ্ব কার্যক্রমে অনেক বছর যাবৎ (১৯৯৬ থেকে মৃত্যুর পূর্ব পর্যন্ত) অনুবাদক ও সংবাদ পাঠক হিসেবে দায়িত্ব পালন করেছেন। বিভিন্ন পত্রিকা ও ম্যাগাজিন সম্পাদনার ক্ষেত্রেও তাঁর রয়েছে অনেক অবদান। তিনি মাসিক মাদরাসা পত্রিকার ভারপ্রাপ্ত সম্পাদকের দায়িত্ব পালন করেছেন। সামাজিক কাজের সাথে তিনি নিজেকে বিভিন্নভাবে সম্পৃক্ত করে রেখেছিলেন। তিনি অ্যারাবিক ফাউন্ডেশন বাংলাদেশ এর প্রতিষ্ঠাতা চেয়ারম্যান ছিলেন। নিবরাস ফাউন্ডেশন বাংলাদেশের নির্বাহী কমিটির সদস্য এবং শিক্ষা ও গবেষণা সেক্রেটারি হিসেবে দায়িত্ব পালন করেছেন।
আল-কুরআনের ভাষা আরবী বিস্তারে তাঁর অবদান :
তিনি আল-কুরআনের একজন একনিষ্ঠ অনুগামী হিসেবে এর ভাষা বিস্তারে ব্যাপক আগ্রহী ছিলেন । তিনি আরবী ভাষা বিস্তারে সর্বদা ব্যাকুল থাকতেন। তাই তাঁর একটি কবিতা বিভিন্ন সভা- সমাবেশে ব্যাপক বিস্তৃতি লাভ করে। তিনি বলতেন-
“যাহা অহী তাহাই ছহীহ, যাহা ছহীহ তাহাই কহি,
অহী ছাড়া ছহীহ নাই, মানতে মোরা বাধ্য নই,
অহী নাযিল আরবীতে, আসুন শিখি আজ হতে…।”
এ কারণে তিনি অ্যারাবিক ফাউন্ডেশন বাংলাদেশ নামে একটি ফাউন্ডেশন প্রতিষ্ঠা করেন। প্রিনিটি মাদবাসা নামে যে পত্রিকাটি সম্পাদনা করতেন তাতে একটি বিশেষ অংশ ছিলো মানুষকে আরবী শিক্ষাদান। তাঁর উদ্যোশের এবং নিবরাস ফাউন্ডেশন বাংলাদেশের ব্যবস্থাপনায় বাঙ্গলাদেশে সর্বপ্রথম আন্তর্জাতিক আরবী ভাষা দিবস পালন করা হয়। হিজরি সন যাতে মানুষ ব্যাপকভাবে পালন করে সে উদ্দেশ্যে তিনি বিশেষ বর্ষপঞ্জি মুদ্রণের জন্য পদক্ষেপ গ্রহণ করেন। ২০১২ সাল থেকে প্রায় প্রতি বছর তিনি এ দিবসটি উদযাপনে ব্যাপক কার্যক্রম গ্রহণ করতেন। তিনি নিবরাস মাদরাসায়, দারুন্নাজাত মাদরাসায় আরবী ভাষা বিষয়ক মেলার আয়োজন করেছেন। সুযোগ পেলেই তিনি শিক্ষার্থীদের সহজে আরবী ভাষা শিক্ষা দিতে চেষ্টাকরতেন। হাজারো ব্যস্ততার মধ্যেও তিনি নিবরাস মাদরাসার শিক্ষাথীদের শনিবার সময় দিতেন। ছোট ছোট শিক্ষার্থীদের আরবী শেখাতে সচেষ্ট থাকতেন এবং তাতে আত্মিক প্রশান্তি অনুভব করতেন।
ব্যতিক্রমী গুণের অধিকারী:
তিনি এমন কতিপয় গুণের অধিকারী ছিলেন যা জীবদ্দশায় তাঁর বন্ধুরা খুব বেশী আমলে না নিলেও তাঁর মৃত্যুর পর বিষয়গুলো বন্ধ-বান্ধব ও স্বজনদের আন্দলিত করে। কয়েকটি দৃষ্টান্ত উল্লেখ না করলেই নয়।
যেমন:
বিনয়ী মুস্তাফিজ: ড. শায়খ মুস্তাফিজ এতটাই বিনয়ী ছিলেন যে, মাঝে-মধ্যে কোথাও তাঁর বন্ধুদের সাথে কোনো অনুষ্ঠানে গেলে কিংবা মসজিদে গেলে তাঁর একজন বন্ধু হয়তো মসজিদ থেকে বের হতে চাচ্ছেন কিন্তু জুতার বক্স থেকে জুতা তার আনতে হয়নি। ড. মুস্তাফিজ এগিয়ে দিতেন। তিনি সেক্ষেত্রে হয়তো তাঁর বয়সের জুনিয়র বা সিনিয়র কিনা সেদিকে খেয়াল করতেন না।
দানশীল মুস্তাফিজ: তিনি এতটা দানশীল ছিলেন যে, হয়তো বাজার করার জন্য বের হয়েছেন ইতোমধ্যে দেখতে পেলেন একজন ভাই অনেক বেশী সমস্যায় পড়েছেন। তখন তিনি বাজারের টাকা তাকে দিয়ে দিয়েছেন আর বাজার না করেই বাড়ি ফিরেছেন।
মিতব্যয়ী মুস্তাফিজ: ড. শায়খ মুস্তাফিজ কোন জিনিসের অপচয় পছন্দ করতেন না। বিশেষ করে খাবারের অপচয় খুবই অপছন্দ করতেন। এমনও দেখা গেছে, শিক্ষার্থীদের সাথে একত্রে খেতে বসেছেন। ছোট ছোট শিক্ষার্থীরা খাবার খেতে না পেরে খাবার রেখে দিয়েছে। তিনি প্লেট থেকে সে খাবার নিয়ে খেয়ে ফেলতেন। নিজের বর্তনকে শতভাগ চেটে খেতেন ড. মুস্তাফিজ। এ ধরণের অনেক গুণের অধিকারী ছিলেন তিনি। তাঁর কর্মের গুণে আমাদের মাঝে জীবিত থাকবেন আজীবন। কবির ভাষায়- ‘নিঃশেষে প্রাণ যে করিবে দান- ক্ষয় নাই! তার ক্ষয় নাই!‘
মৃত্যু:
তিনি ৮ মে ২০২১ শনিবার, ২৫ রমাদান, সকাল ১০ টায় মহান রবের ডাকে সাড়া দিয়ে আমদের ছেড়ে চলে গিয়েছেন। আল্লাহ তাঁর প্রতিটি ভালো আমল কবুল করুন। তাঁর ত্রুটি-বিচ্যুতিগুলো ক্ষমা করে দিন এবং তাঁকে জান্নাতের উঁচু মাকাম দান করুন- সে দু‘আ করি।